শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৪:১৩ অপরাহ্ন

ভেঙে পড়েছে ঋণ প্রবৃদ্ধি

অর্থনীতি ডেস্ক, নগরকন্ঠ.কম : বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৯-২০) বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। পুরো অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে মাত্র ৮.৬১ শতাংশ। এটি গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি। তবে সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বার্ষিক ২৪.৩ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আঘাতের পর আঘাতে তছনছ বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি। উচ্চ ঋণখেলাপি, তারল্য সংকট, ঋণ-আমানতের সুদহার কার্যকরে টানাপোড়েনে দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারি ঋণের গতি ছিল বেশ মন্থর। এরপর মহামারী করোনার আঘাতে অর্থবছর শেষে তা আরও নিম্নমুখী হয়ে পড়ে। তাদের মতে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। কারণ দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির বড় অংশই আসে এই খাতের মাধ্যমে। তাই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও এর প্রভাব পড়বে। কাঙ্ক্ষিত শিল্পায়ন হবে না। কর্মসংস্থানও বাধাগ্রস্ত হবে।

জানতে চাইলে অর্থনীতির গবেষক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি খাতে ৮.৬১ শতাংশের যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে, এটাও সঠিক নয়। কারণ এখানে গত কয়েক মাস পরিশোধ করতে না পারা ঋণ ও সুদও নতুন ঋণ হিসেবে যোগ হয়েছে, যা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। সেক্ষেত্রে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাবে। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ কমার হার বিগত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এমনটি আর কখনও দেখিনি। বাস্তবে বিনিয়োগ পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তিনি আরও বলেন, এখন তো করোনার কারণে সমস্যা। কিন্তু করোনার আগে থেকেই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ ছিল।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অর্থবছরের প্রথমার্ধে উচ্চ ঋণখেলাপি, তারল্য সংকট, ঋণ-আমানতের সুদহার কার্যকরে টানাপোড়েন, আমদানি-রফতানির গতি কমসহ সার্বিকভাবে বিনিয়োগের পরিবেশ কম ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে করোনার আঘাতে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম থেমে যায়। ফলে অন্তহীন সমস্যায় পড়েছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। আর বেসরকারি খাত চাঙ্গা না হলে দেশের সার্বিক বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হবে।

জানা গেছে, দুই বছর আগেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির চিত্র এমন ছিল না। বেশকিছু ব্যাংকের আগ্রাসী বিনিয়োগের কারণে ওই সময় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের শুরুতে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের লাগাম টানতে ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কিছুটা কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। যদিও এরই মধ্যে কয়েক দফা এডিআর সীমা বাড়ানো হয়েছে। তবুও ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮-১৯ জুন শেষে বেসরকারি খাতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৩২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুনে সেই প্রবৃদ্ধি আরও নেমে এসেছে ৮.৬১ শতাংশে। এটি চলতি মুদ্রানীতিতে প্রক্ষেপিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬.১৯ শতাংশ কম।

জানতে চাইলে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অর্থবছরজুড়ে ছিল সমস্যা। একেক সময় একেক সমস্যা। শুরুতে বিনিয়োগ পরিবেশ কাঙ্ক্ষিত ছিল না। এরপর ঋণ-আমানত রেশিও (এডিআর) নিয়েও কিছুটা সমস্যা ছিল। তারপর এলো করোনার আঘাত। ফলে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি আর বাড়ল না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুন শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯৭ হাজার ২৭১ কোটি টাকা, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুনের চেয়ে ৮.৬১ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ১০ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। এই হিসাবে গত এক বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৮৭ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সর্বোচ্চ ২৫.৮০ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি কমে হয় ১৯.৬৮ শতাংশ। এর পরের ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনকভাবে কমে দাঁড়ায় মাত্র ১০.৮৫ শতাংশে। এরপর টানা তিন অর্থবছর প্রবৃদ্ধি বাড়ছিল। ২০১৩-১৪ অর্থবছর প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে হয় ১২.২৭ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা কিছুটা বেড়ে ১৩.১৯ শতাংশ হয়। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে হয় ১৬.৭৮ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই গতি কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১৫.৬৬ শতাংশে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সেটি আবার বেড়ে হয় ১৬.৯৪ শতাংশ। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনক হারে কমে এক লাফে নেমে আসে ১১.৩২ শতাংশ। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে তা আরও কমে ৮.৬১ শতাংশে নেমে এসেছে।

নগরকন্ঠ.কম/এআর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com