রবিবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২১, ০৬:৪৪ অপরাহ্ন
চাকরিতে নিয়োগ, পেশাদার গাড়িচালকদের নতুন লাইসেন্স গ্রহণ কিংবা নবায়ন ও চাকরিরত সন্দেহভাজনদের মাদক গ্রহণের প্রবণতা আছে কিনা জানার জন্য ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। কিন্তু রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালসহ অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে এ ব্যবস্থা নেই। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে টেস্ট প্রত্যাশীদের। তাছাড়া অনেকে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে ডোপ টেস্ট করেন। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি অসাধু ব্যক্তিদের দ্বারা মাদক পরীক্ষা প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইন্সেস গ্রহণসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করায় রংপুরে টেস্ট প্রত্যাশীদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু বিভাগীয় নগরীতে সরকারিভাবে ডোপ টেস্ট না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা।
রংপুরে জেলায় সদ্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের ডোপ টেস্টের বিষয়টি দেখভাল করছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন দু-একটি আবেদন আসছে ডোপ টেস্টের জন্য। যেহেতু রংপুরে সরকারিভাবে টেস্ট হয় না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. হিরম্ব কুমার রায় বলেন, রংপুরে সরকারিভাবে ডোপ টেস্ট চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান স্টাফদের (সন্দেহভাজন) ডোপ টেস্টের জন্য তাদের কাছে আবেদন করলেও কেউ কেউ বেসরকারি পর্যায়ে পরীক্ষা করাতে বেশি টাকা প্রয়োজন হওয়ায় আপাতত আগ্রহী হচ্ছেন না। তবে কেউ যদি দূরের সরকারি হাসপাতাল থেকে ডোপ টেস্ট করে রেজাল্ট নিয়ে আসেন তাহলে তা গ্রহণ করা হচ্ছে।
এদিকে ডোপ টেস্ট করাতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন পেশাদার গাড়িচালকরা। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে নতুন লাইসেন্সসহ পুরনো লাইসেন্স নবায়ন করতে প্রয়োজনীয় কাগজের পাশাপাশি ডোপ টেস্ট রিপোর্ট জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। কিন্তু রংপুর নগরীতে কোনো সরকারি হাসপাতালে এ টেস্টের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তাই অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে ডোপ টেস্টের রিপোর্ট নিতে হচ্ছে চালকদের।
রংপুর বিআরটিএ সার্কেল অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন কমপক্ষে তিন-চারজন আসেন পেশাদার লাইসেন্স সংক্রান্ত বিষয়ে।
বিআরটিএ, রংপুর সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মো. ফারুক আলম বলেন, গাইবান্ধা জেলায় সরকারিভাবে ডোপ টেস্ট হচ্ছে অথচ রমেক হাসপাতালে ডোপ টেস্ট আজো চালু করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, পেশাদার চালকদের মাদকাসক্ত কিনা তা নিশ্চিত হতে পাঁচটি নির্দিষ্ট বিষয়ে টেস্ট প্রয়োজন হয়। রংপুরে সরকারিভাবে যেহেতু টেস্ট হচ্ছে না, ফলে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরীক্ষার ফলাফল গ্রহণ করতে হচ্ছে।
একাধিক গাড়িচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাইবান্ধা এবং বগুড়ায় সরকারিভাবে ডোপ টেস্ট করতে ১ হাজার টাকার কম খরচ হয়। সেখানে বেসরকারি একই টেস্ট করাতে খরচ ২ হাজারের বেশি লাগে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর রংপুর জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত রংপুরের সাতটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ২৬২ জন মাদকাসক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। যদিও করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন চিকিৎসাসেবা বন্ধ না থাকত, তাহলে চিকিৎসাপ্রার্থীর সংখ্যা বাড়ত। রংপুর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের অভিযানে স্পট থেকে মাদক সেবনকালে ধরা পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায়ই সরকারি চাকরিজীবীদেরও পাওয়া যায়। তাই রংপুর বিভাগীয় নগরীতে সরকারিভাবে ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি।
রংপুরের গুড হেলথ হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক এবং ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মামুনুর রহমান বলেন, অবৈধ ও নিষিদ্ধ মাদকসেবীদের শনাক্ত করার জন্য ডোপ টেস্টের প্রয়োজন হয়। সাধারণত এনালাইজার মেশিনের মাধ্যমে মাদক শনাক্ত করা হয়। ডোপ টেস্টের জন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তির রক্ত, মূত্র অথবা ঘাড়ের স্পাইনাল ফ্লুইড সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। রক্তে মাদকের উপস্থিতি দুই মাস, মূত্রে ১০ দিন ও ঘাড়ের স্পাইনাল ফ্লুইডে ১২ মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়।
ডোপ টেস্ট চালু সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করলেও রংপুরে এর সঠিক নিয়ম বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মো. আকবর হোসেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডোপ টেস্ট অব্যাহত থাকলে প্রতিবেদন তৈরিতে অপরাধীদের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা থাকে। তাই অবিলম্বে রমেক হাসপাতালে ডোপ টেস্ট চালু করে তা নির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত করার দাবি জানান তিনি।
সার্বিক বিষয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. একেএম নুরুন্নবী লাইজু বলেন, মেডিকেল কলেজে ডোপ টেস্ট চালু করতে আমার কোনো দ্বিমত নেই। এর আগে বিষয়টি নিয়ে কোনো পক্ষই আমাকে কিছু বলেননি। জেলা প্রশাসন থেকে যদি পদক্ষেপ নেয়া হয়, তাহলে তা বাস্তবায়নে অনেক সুবিধা হবে।
তিনি বলেন, মাত্র তিনদিনের নোটিসে রংপুর মেডিকেল কলেজে কভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য পিসিআর মেশিন স্থাপন করেছিলাম। তাই ডোপ টেস্ট চালু করতেও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।