বুধবার, ২০ জানুয়ারী ২০২১, ০৭:১৪ অপরাহ্ন
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
পদ্মাসেতুর ৩টি স্প্যান বসানো হয়েছে, আর বাকি আছে মাত্র দুটো। ডিসেম্বর মাসেই সবগুলো স্প্যান বসানো শেষ হওয়ার পর রেললাইনের কাজটিও দ্রুত শেষ হবেÑএমনটিই সেতু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ২০২১ সালে স্বপ্নের পদ্মাসেতু বাস্তবেই পরিবহন পারাপারের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন। পদ্মাসেতু নিয়ে একদিকে স্বপ্ন, পরিকল্পনা এবং নির্মাণের উদ্যোগ-যুদ্ধ, অন্যদিকে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার, গুজব ইত্যাদি শুনতে হয়েছে। এখনো বাংলাদেশের মানুষের একটি বিরাট অংশ, যারা পদ্মা সেতু নির্মাণকে মোটেও ভালো চোখে দেখছিল না, পরশ্রীকাতরতা যাদের ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক বিশ^াসে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তারা এই সময়ে প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে দেশি-বিদেশি একটি মহল বাংলাদেশের মানুষকে শ্রমিক বানিয়ে রখার জন্য পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকারকে ইন্ধন যুগিয়েছে, ৩০ হাজার কোটি টাকাই পদ্মা নদীর জলে ভাসিয়েছে, দেশের কোনো উন্নয়ন পদ্মা সেতুর ফলে ঘটবে না।
পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার উদ্যোগ গ্রহণের শুরুতেই যারা এই প্রচার-প্রচারণা করেছিলো তাদের ধারাবাহিক অপপ্রচারের সর্বশেষ সংযোজন হলো এটি। এই গোষ্ঠী পদ্মা সেতু নিয়ে অপপ্রচার ও বিরোধিতা করেই যাবে, পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে তারা গাড়ি নিয়ে বা ট্রেনযোগে যাবে কিনা জানি না, তবে ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তিরা তাদের হীনমন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকবে। শেখ হাসিনাবিরোধী একটি গোষ্ঠী একইভাবে পদ্মা সেতুর বিরোধিতা, অপপ্রচার, গুজব ছড়ানোর সব চেষ্টা করেও শান্ত হচ্ছে না এটি বিস্ময়কর।
যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার পর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ সহজ হওয়ার কারণে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা অতীত ইতিহাসের বিষয় হয়ে গেছে। এর মানে হচ্ছে উত্তরবঙ্গেও দারিদ্র্য দ্রুতই কমে আসতে শুরু করেছে, উত্তরাঞ্চলের ফসলাদি রাজধানীসহ অন্য অঞ্চলে দ্রুত পরিবহন করার ফলে কৃষিজ ও ফলজ পণ্য উৎপাদনে উত্তরাঞ্চলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন দ্রুত ঘটার সুযোগ তৈরি হয়।
এমন একটি সফল দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের সামনে দেদপ্যিমাণ থাকার পরও যারা পদ্মা সেতু নিয়ে সন্দেহ, অপপ্রচার, সরকারের বিরোধিতা এবং নানা ধরনের উদ্ভট গল্প ছড়াচ্ছেন তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এটি সকলেই জানে যে খুলনা, যশোরসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলর জেলাসমূহের সঙ্গে ঢাকা এবং দেশের পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগে এখনো বড় বাধা হয়ে আছে বিশাল ও উত্তাল পদ্মানদী। বিভিন্ন ঘাট ও ফেরী পার হওয়ার কষ্টকর অভিজ্ঞতা এসব অঞ্চলের মানুষের এতোদিনকার সঙ্গী হয়ে আছে। ফেরি পারাপারের সমস্যা ও জটিলতার কারনে মানুষ, যানবাহন, মালামাল নদীর তীরে কখনো-বা দিনের পর দিন পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে, অনেক রোগী মৃত্যুবরণ করেছে, কাঁচামাল নষ্ট হয়েছে, মানুষের দুর্ভোগ চরমতর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, কিন্তু কারোই কিছু করার সুযোগ ছিলো না। অনেক মানুষ উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করে স্পিডবোটে পারাপার হতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে। এসব দুর্ভোগ-অভিজ্ঞতার কথাতো সবারই জানা। এমন পরিস্থিতিতে পদ্মা নদীর উপর কখনো সেতু হবে এটি অনেকেরই কল্পনাতেই আসেনি।
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর স্বপ্নের কথা দেশবাসীকে জানান। তিনি যখন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন তখন দেশি-বিদেশি একটি গোষ্ঠী নানা কাল্পনিক দুর্নীতির গল্প দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে থাকে। এ নিয়ে পদ্মা নদীর জল অনেক ঘোলা করা হয়েছিলো। তিনি চ্যালেঞ্জ নিলেন, দেশীয় অর্থ এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশে^র এই সর্ববৃহৎ সেতুটি নির্মানের কাজ শুরু করলেন। আমরা এখন দিব্যি দেখতে পাচ্ছি পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, গুজব, অপপ্রচার, মিথ্যাচার পদ্মার ঘোলাজলে ভেসে যাচ্ছে।
এই সেতুটি যানবাহন ও ট্রেন পারাপারে উন্মুক্ত হয়ে গেলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যাতায়াত হবে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপারÑযা এখন কয়েক দিনের ব্যাপার। পারাপারের এই সুযোগ যাত্রীদের চলাচলেই শুধু নয়, বরং এতে দেশের কৃষি, মৎস্য. গবাদিপশু, শিল্পপণ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, বৈদেশিক পণ্য আদান-প্রদান দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ার পথও উন্মোচন করবে। পদ্মাপারের পশ্চিম তীরের মানুষ নতুন নতুন অর্থনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত হওয়ার দ্রুত সুযোগ পাবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এখনই পদ্মাপারের উভয় তীরে নানা ধরনে স্থাপনা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ছোট ছোট নগর গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সেতু উদ্বোধনর পর গোটা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ অঞ্চলের দূর উপকূলের মানুষের সংযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি নানান ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা-েও তারা গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের জাতীয় আয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। পদ্মাসেতু উদ্বাধনের পর নতুন নতুন অর্থনৈতিক জোন, ক্ষেত্র, প্রতিষ্ঠান এবং নানা ধরনের সম্ভাবনাময় দিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠবেই এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মত লাভজনক স্থাপনাও ওই অঞ্চলে গড়ে উঠার চাহিদা তৈরি হবে। এই সবকিছুই ঘটবে পদ্মা সেতুর কল্যাণে।
৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যারা এখন বুক চাপড়াচ্ছেন, অর্থনীতি নিয়ে মায়াকান্না করছেন তারা অচিরেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পদ্মাপারের ওই অঞ্চল বছরে লাখ লাখ কোটি টাকা উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করবে, শুধ সেই অঞ্চলেরই নয়, গোটা দেশের অর্থনীতির ধমনীতে নতুন রক্তপ্রবাহ সৃষ্টি হবে। এটি তখন আর শুধু শেখ হাসিনার স্বপ্ন হিসেবেই থাকবে না, বরং সমগ্র দেশের মানুষ এবং এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি বেশি^ক উন্নয়ন অঙ্গনে এক উজ্জল দৃষ্টান্ত হিসেবে মূর্তমান থাকবে। লেখক : শিক্ষাবিদ