বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৪ অপরাহ্ন

শিমু : চলচ্চিত্রের নতুন বিস্ময়

শিমু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন এক বিস্ময়। পুরো নাম রিকিতা নন্দিনী শিমু। এখন শিমু নামেই পরিচিত তিনি। ক্যারিয়ার অল্প দিনের হলেও এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে শিমু। কারণ সম্প্রতি ঘোষিত ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০২২’ এর জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে এই পুরস্কার জয়া আহসানের সঙ্গে যৌথভাবে পাচ্ছেন রিকিতা নন্দিনী শিমু। পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত ‘শিমু’ সিনেমা ও চরিত্রের জন্য এ পুরস্কার পাচ্ছেন তিনি।

বাস্তবে তার নাম ‘শিমু’ আবার সিনেমার নামও তাই। স্বনামেই এমন অর্জনে ভীষণ উচ্ছ্বসিত তিনি। বহু অভিনেত্রী আছেন যাদের ক্যারিয়ার অনেক দীর্ঘ ও সংগ্রামী হলেও জীবনে একটিও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি। কিন্তু শিমুর ক্ষেত্রে একেবারেই উল্টো হয়েছে। তিনি এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। যদিও সিনেমাটি তার ছয় নম্বর সিনেমা। কিন্তু চলচ্চিত্রে পা রাখার সংক্ষিপ্ত সময়েই কব্জা করে নিয়েছেন দেশীয় সিনেমার সবচেয়ে গর্ব ও অহংকারের বস্তু ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’ হিসেবে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’।

একজন শিল্পীর জীবনে যত সাফল্যই জুটুক, দেশের বাইরে ও অভ্যন্তরীণ নানা প্রতিষ্ঠান থেকে যত পুরস্কারই জুটুক যদি তার ক্যারিয়ারে অন্তত একটিবার এই পুরস্কার না জোটে তখন মুখ ফুটে না বললেও শিল্পী জীবনভরই অন্তরে-অন্তরে একটা অপ্রাপ্তি বা অতৃপ্তিতে ভুগবেন বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে শিমু বড়ই ভাগ্যবতী, ক্যারিয়ারের শুরুতেই এমন সম্মানজনক পুরস্কারটি পেয়ে গেলেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হিসেবে এটা প্রথম হলেও ইতোমধ্যেই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং দেশের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে তার কাজের জন্য পুরস্কারসহ প্রশংসিত হয়েছেন।

ওই সাফল্যের পরই অনেকে আন্দাজ করেছিলেন খুব সহসাই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারটিও পেয়ে যাবেন তিনি। সেটাই হয়ে গেল। ছবিটির নাম অর্থাৎ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম যেমন শিমু, তেমনি রিকিতা নন্দিনীর ডাক নামও শিমু। বাস্তব আর গল্পের মানুষটির নাম যখন একই হয়ে যায় তার ওপর সেই চরিত্রটির জন্য এমন পুরস্কার পাওয়া যায় তখন তো অভিনেত্রীর জন্য অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠা সেটাই স্বাভাবিক!

ফলে পুরস্কারের সংবাদটি পাওয়ার পর বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না রিকিতা নন্দিনী। ক্যারিয়ারের এত অল্প সময়েই এমন পুরস্কার পাওয়ায় কেমন লাগছেÑ এ নিয়ে যায়যায়দিনের পক্ষ জানতে চাওয়া হলে তিনি খুবই আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং বলেন, ‘সত্যি-সত্যিই পুরস্কারটি পেয়ে আমার অনেক ভালো লাগছে বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো কাজের স্বীকৃতি পেলে এমনিতেই অনেক ভালো লাগে। তখন কাজের প্রতি আরও দায়িত্বও বেড়ে যায়। কাজও আরও ভালো হয়। তো, আমি অনেক কৃতজ্ঞ আমার ডিরেক্টরের কাছে। তবে পুরস্কার পাওয়া এই যে এত ভালো লাগা, এই আনন্দ সেলিব্রেট করতে পারিনি আমরা। কারণ, আপনারা হয়ত জেনে থাকবেন, কয়দিন আগেই আমাদের সিনেমাটির পরিচালক রুবাইয়াত আপুর বাবা ইন্তেকাল করেছেন। এ জন্য আমরা সবাই খুব আপসেট ছিলাম। আঙ্কেল যদি থাকতেন তাহলে অনেক ভালো লাগত। সবাই একসঙ্গে সেলিব্রেট করতে পারতাম।

আমাদের মনটা খুব খারাপ। কারণ, আঙ্কেল আমাদের কাজটি নিয়ে অনেক ইন্সপায়ার করতেন। তো, আমাদের টিম থেকে অলরেডি চারটি পুরস্কার পেয়েছে। সত্যি এটা আমাদের টিমের সবার জন্যই অনেক বড় একটা পাওয়া। এটা এত বেশি ভালো লাগা যে, এটা অন্যকিছুর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। সবার আগে পুরস্কার পাওয়ার খবরটি জানান বাঁধন আপু (অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন) তিনিই প্রথম শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাকে এসএমএস করেন। প্রথমে আমার বিশ্বাসই হয়নি। মনে করেছি, হয়ত তিনি ভুলে আমাকে টেক্সটি পাঠিয়েছেন। এরপর নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকি ভাই ফোন করে অভিনন্দন জানান। তখন মনে হলো, হলে হতেও পারে। তাকে বললাম ভাইয়া, আপনার ভুল হচ্ছে না তো! তারপর তিনি প্রজ্ঞাপন পাঠিয়ে আমাকে নিশ্চিত করেন।’

প্রসঙ্গত, এই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার আগে রিকিতা নন্দিনী শিমু ফ্রান্সের একটি পুরস্কার লাভ করেন। তখন সেই পুরস্কারপ্রাপ্তির প্রসঙ্গটি আসলে শিমু জানান, ‘এর আগে ফ্রান্স থেকে এবং আরেক জায়গা থেকে পুরস্কার পেলেও মাটির পুরস্কার, মাটির মানুষ থেকে পাওয়া পুরস্কারের কোনো তুলনা হয় না। দেশের মানুষের কাছ থেকে এত ভালোবাসা, এত প্রশংসা পাওয়া, সেটা তো অন্য রকম অনুভূতির ভালোলাগা। এর সঙ্গে তো কোনো কিছুরই তুলনা হতে পারে না। এমন একটা পুরস্কার পেলে তো তখন মনটা অনেক বড় হয়ে যায়। অনেক বেশি ভালোলাগে। সত্যিই বলার অপেক্ষা রাখে না, আমি অনেক অনুপ্রাণিত হই এই পুরস্কারে। এটা আমার সারাজীবনের জন্যই একটা অমোচনীয় স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমি এখন এমন কাজ করতে চাই যেটা মানুষের দীর্ঘদিন মনে থাকবে। আমার জন্য দোয়া করবেন।’

বহু অভিনয় শিল্পী আছেন যারা সারাজীবন কাজ করেছেন, তিন চার শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন তারপরেও তাদের কপালে কোনো একটি পুরস্কার না জোটার যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হয়েছে সেখানে রিকিতা নন্দিনী শিমুর অভিনীত সিনেমার সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। ‘শিমু’ রিকিতা নন্দিনীর ষষ্ঠ সিনেমা। শিমু বলেন, ‘আমি খুব অল্প কাজ করেছি। তবে আমার সব সময়ই ইচ্ছা ছিল ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মের কাজগুলো করার। সব সময়ই আমার চাওয়া ছিল, ‘আমি যেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড অর্জন করতে পারি। এমন কাজ করতে পারি সে কারণেই আমাকে বাংলাদেশের সিনেমায় বা অন্যান্য কন্টেন্টগুলোতে কম দেখা যায়। তবে আমি পাশাপাশি ওটিটিতে, টিভিসিতে কাজ করছি। তবে দিনশেষে আমার চাওয়া আমি ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মগুলোতেই কাজ করতে চাই।’

‘শিমু’ সিনেমাটি ছাড়াও আরও একটি সিনেমা আছে যেটা কলকাতা থেকে নির্মিত হয়েছে। বিক্রম আদিত্য সেনগুপ্ত পরিচালিত এই ছবিটির নাম ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন কলকাতা’। এই ছবিটিও দেশের বাইরে বিভিন্ন ফেস্টিভালে প্রশংসিত হয়েছে। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে ছবিটি। এখন মুক্তির অপেক্ষায় আছে এ ছবিটি।

রিকিতা নন্দিনী প্রথম থেকেই প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের অধীনে কাজ করে আসছেন। এ থেকেও বোঝা যায় রিকিতা নন্দিনী শিমু একটা স্বপ্ন নিয়েই চলচ্চিত্রাঙ্গনে পা রেখেছেন। তারেক মাসুদ, রুবাইয়াত হোসেন ও বিক্রম আদিত্য সেনগুপ্তের মতো উল্লেখযোগ্য নির্মাতার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। শিমু অভিনীত উল্লেখযোগ সিনেমার মধ্যে আছে তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’, ইমতিয়াজ আহমেদ বিজন পরিচালিত ‘মাটির প্রজার দেশে’, রুবাইয়াৎ হোসেন পরিচালিত ‘আন্ডারকন্সট্রাকশন’ প্রভৃতি।

চলচ্চিত্রে আসার আগে শিমু মঞ্চে অভিনয় করতেন। সাধারণত যারা থিয়েটারে অভিনয় করেন তারা প্রথমে ছোটপর্দাতেই কাজ করেন। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে শিমু বলেন, ‘আমি থিয়েটারে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর ইউনিসেফের সহযোগিতায় আবুল হায়াৎ আঙ্কেলের ২৬ পর্বের ‘আলো আমার আলো’ নামের একটি ধারাবাহিকে শিশুশিল্পী ‘আলো’ ক্যারেক্টারটি করি। এরপরে তারেক মাসুদ আঙ্কেল আমাকে ‘রানওয়ে’ সিনেমায় কাস্ট করেন। ওই সিনেমাটি করার পরই আমি বুঝি, ফিল্ম মানেই এরকমই হবে। তখনই সিদ্ধান্ত নিই, আমি ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মের সিনেমায় কাজ করব।’

নতুন কাজ করা নিয়ে বলেন, ‘চক্কর’ নামের একটি সরকারি অনুদানের সিনেমার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। আর এক বছর হলো একটি ইরানি পরিচালক মুর্তজা অতাশ জমজমের ‘ফেরেশতে’ ছবিতে সিনেমায় যুক্ত হয়েছি। এই সিনেমায় আমি ছাড়াও জয়া আপাও আছেন।’

সিনেমার বাইরে কাজ করা নিয়ে বলেন, ‘নাটক হোক, ওটিটি হোক বা টিভিসি যা-ই হোক সব কাজই করতে আগ্রহী আমি। এমনকি ফুল কমার্শিয়াল সিনেমাতেও অভিনয় করতে আপত্তি নেই যদি গল্পটি পছন্দ হয়, ক্যারেক্টারটা আমার সঙ্গে যায় এবং কাজটি যদি আমার জন্য কম্ফোর্টেবল হয়। তবে এই মুহূর্তে আমি কমার্শিয়াল সিনেমা নিয়ে ভাবছি না।’

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com