বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৩:১৩ অপরাহ্ন

উপসর্গ নিয়ে এসে অন্তহীন দুর্ভোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, নগরকন্ঠ.কম : মা-ছেলের ভালোবাসা এমনই হয়। অসম্ভব ছোঁয়াচে করোনার বিস্তারের এই দুঃসময়েও চিরন্তন সেই ভালোবাসায় কোনো কমতি নেই। সোমবার করোনা উপসর্গ নিয়ে ২৫ বছর বয়সী ছেলেকে সঙ্গে করে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে এসেছিলেন মা। নমুনা দেয়ার জন্য প্রখর রোদের মধ্যে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছিল ছেলে। করোনার ভয়াবহতা জেনেও মা বারবার ছেলের কাছে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করছিলেন। অজানা শঙ্কার কথা ভেবে ছেলে হাতজোড় করে বলছিল, ‘মা- তুমি দূরে থাকো- আমাকে জড়িয়ে ধরো না, প্লিজ মা, দূরে থাকো।’ কে শোনে কার কথা, মা বারবারই ছেলেকে বুকে টেনে নিচ্ছিলেন- যদি ছেলের কষ্ট কিছুটা কমে।

মাকে সামলাতে না পেরে এক পর্যায়ে ছেলে রাগ করেই মায়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে প্রচণ্ড রোদে বসলেন। মাকে ইশারায় বলছিলেন, তুমি ছায়ায় বসো, আমার কিছু হবে না- তোমার কিছু হলে আমরা (৫ সদস্যের পরিবার) বাঁচব না। সোমবার দুপুরে মুগদা জেনারেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে মা-ছেলের এমন দৃশ্য চোখে পড়ে যুগান্তরের এ প্রতিবেদকের। তারা এসেছেন কেরানীগঞ্জ থেকে। এ সময় টেস্ট করার সুযোগ না পেয়ে করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা শত শত ব্যক্তি ও স্বজন হা-হুতাশা করছিলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে বেশির ভাগ রোগী নমুনা না দিয়েই বাড়ি ফিরে যান।

তবে মুগদা হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনে মাত্র ১৭১ জনের নমুনা নেয়ার সুযোগ রয়েছে তাদের। এর মধ্যে সাধারণ ব্যক্তি ৭১ জন, স্টাফ ৫০ জন ও রোগী ৫০ জন। সাধারণ ব্যক্তিদের মধ্যে সকালে ৫০ জন এবং বিকালে ২১ জন। অথচ করোনা উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিন শত শত লোক আসছে। ৫০০ বেডের হাসপাতাল করোনা ডেডিকেটেড করার পর শয্যা সংখ্যা কমে ৩০০ বেডে দাঁড়িয়েছে। আইসিইউ’র সংখ্যা মাত্র ১০টি। প্রতিদিন ১০-১২ জনের বেশি রোগী ভর্তি করানো সম্ভব হচ্ছে না কোনোক্রমেই।

কথা হয় হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. আবুল কাশেম শেখের সঙ্গে। তিনি জানান, দিন দিন করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু আমাদের তো সীমিত চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে। আমরা সকালে ৫০ জন এবং বিকালে ২১ জনের নমুনা সংগ্রহ ও টেস্ট করি। অথচ কয়েকশ’ লোক অপেক্ষা করেন টেস্ট করাতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন।

আমাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করছি। সাধারণ মানুষকে বলছি ফোনে যোগাযোগ করে আসতে। কে শোনে কার কথা। মানুষের চাপ বাড়ছে, কিন্তু কিছুই করা যাচ্ছে না। এই হাসপাতালে মোট জনবল ১০৮৩। এদের মধ্যে ডাক্তার ২১৩ এবং সিস্টার ৭২ জন। তারা ৭ দিন করে ডিউটি করার পর ১৪ দিন নির্ধারিত জায়গায় থাকার পর ৭ দিন পরিবারের সঙ্গে থাকছেন। ২১ দিন পর পুনরায় হাসপাতালে এসে কাজে যোগ দিচ্ছেন। বর্তমানে কোনো বেড-আইসিইউ খালি নেই। দোষ নয়, সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যাদের ভর্তি করানো হচ্ছে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।

টঙ্গী থেকে আসা ডা. রাসেল সোমবার দুপুরে হাসপাতাল ত্যাগ করছিলেন। তিনি জানান, ১৬ দিন আগে ভর্তি হয়েছিলাম। চিকিৎসা খুব ভালো হচ্ছে। তবে এখানে বেড ও আইসিইউ’র স্বল্পতা রয়েছে। অন্যদিকে বিকাল ৩টার দিকে কেরানীগঞ্জ থেকে আসা রাহাত (২৫) গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পাশে বসে মা কাঁদছিলেন। মা সালমা আক্তার বলছিলেন, সকালে এসেছিলাম কিন্তু টেস্ট করাতে পারিনি। বিকালে টেস্ট করানোর অপেক্ষায় আছি। ছেলে কাছে যেতে দেয় না, এখন ঘুমিয়ে পড়ায় পাশে বসে আদর করছি। ছেলে শুধু চিন্তা করে- আমার যেন এ রোগ না হয়, হলে যেন শুধু তারই হয়। কথাগুলো বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা সালমা আক্তার।

কথা হয় করোনা উপসর্গ নিয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। বলেন, ছেলেকে নিয়ে এসেছি পরীক্ষা করাতে। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ব্যর্থ হয়েছি। আমার মতো অনেকেই টেস্ট করাতে পারেননি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাত্র ৫০ জনের নমুনা নেয় তারা। শত শত লোক অপেক্ষা করে চলে যাচ্ছে। যাত্রাবাড়ী থেকে মা আফরোজা আক্তারকে নিয়ে এসেছেন মেয়ে সামসুন্নাহার। মেয়ে জানান, অভিযোগ নয়- দুর্ভাগ্য এমন একটি দেশে জন্ম নিয়েছি। কেন চিকিৎসা করাতে পারব না, কেন পর্যাপ্ত বেড, আইসিইউ থাকবে না। কেন মাত্র সকালে ৫০টি এবং বিকালে ২১টি টেস্ট করানো হবে। প্রচুর মানুষ আসছে টেস্ট করাতে, সেবা না পাওয়ায় ক্ষোভ আর ঘৃণায় ফিরে যাচ্ছেন।

নগরকন্ঠ.কম /এআর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com