সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:১৬ অপরাহ্ন

পোশাক শিল্প ডিসেম্বর থেকেই ঘোষিত নতুন মজুরি বাস্তবায়ন করবে

বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি এক সংকটময় মুহুর্ত অতিক্রম করছে। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধারে লিপ্ত রয়েছে, তখন পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়ে শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। সেই ধাক্কায় বিশ্বে রেকর্ড মূল্যস্ফীতির যে চাপ তৈরি হয়, তা এখনো শেষ হয়নি। এরই মধ্যে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে আবারও ঘোরতর অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব আমাদের দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে পোশাক শিল্পে অনুভূত হবে।

এমনিতেই জ্বালানি তেল ও খাদ্যপন্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে বিশ্বব্যাপী নজীরবিহীন যে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে, তা নিয়ন্ত্রনের জন্য এখন উন্নত দেশগুলো সংকোচনশীল মূদ্রানীতি গ্রহন করায় ভোক্তাদের আয়, ব্যয় এবং পণ্যের চাহিদায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফলশ্রুতিতে আমাদের পন্যের খুচরা বিক্রয় কমে গেছে, প্রধান বাজারগুলোর পোশাক আমদানি কমে এসেছে।

চলতি ২০২৩ (পঞ্জিকা বছর) এর প্রথম ৯ মাসে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামগ্রিক পোশাক আমদানি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে এসেছে। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক পোশাক আমদানি ভ্যাল্যুতে কমেছে ২২.২৭%, যেখানে বাংলাদেশ থেকে তাদের আমদানি কমেছে প্রায় ২৩.৩৩%, – শুধুমাত্র আগষ্টেই কমেছে ৩৩.৭১%, সেপ্টেম্বরে কমেছে ৩৪.৭২% । অন্যদিকে এই ৯ মাসে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে।

চলতি ২০২৩ (পঞ্জিকা বছর) এর প্রথম ৮ মাসে ইউরোপের বৈশ্বিক আমদানি কমেছে ৯.৬১% এবং বাংলাদেশ থেকে কমেছে ১৩.৭১%, শুধু মাত্র আগষ্ট মাসেই কমেছে ২৬.০৬%।

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক কারণের জের ধরে পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বহুগুন বেড়েছে। বিগত ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সময়ে গ্যাসের মূল্য বেড়েছে ২৮৬.৫% এবং বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে ২১.৪৭%। গত ৫ বছরে পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৪০% বেড়েছে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে দেশের সামগ্রিক রপ্তানি অক্টোবর ২০২২ এর তুলনায় ১৩.৬৪% হ্রাস পেয়েছে। এবং ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে পোশাক রপ্তানির কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রকৃত রপ্তানি পারফরমেন্স ২৮.৩৫% নিচে নেমে এসেছে।

তারপরও দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে বাজার ধরে রাখার জন্য উদ্যোক্তারা নামমাত্র উৎপাদন মূল্যে এমনকি তার চেয়েও কম মূল্যে অর্ডার গ্রহন করে চলেছেন। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন, পাশাপাশি ইনোভেশন, ডিজিটালাইজেশন, পন্য ও ফাইবার ডাইভারসিফিকেশন, ডিজাইন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ করছেন, যদিও এসব বিনিয়োগেও আমাদের ব্যয় অনেক বেড়েছে।

সকল উদ্যোক্তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, শ্রমিক ভাইবোনরাই পোশাক শিল্পের প্রান। তারা ভালো থাকলে শিল্প ভালো থাকবে। তাদের কর্মসংস্থানের খাত, পোশাক শিল্পকে সুরক্ষিত রাখার জন্য শিল্পে নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করতে উদ্যোক্তারা এতো সব সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও ধৈর্য্য সহকারে একের পর এক বিনিয়োগ করেই চলেছেন। তারা যেন আরামদায়ক পরিবেশে থেকে কাজ করতে পারেন, সেজন্য উদ্যোক্তারা প্রযুক্তি ও মেশিনারি আমদানিতে বিনিয়োগ করে চলেছেন।

স্থানীয় পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারনে আমাদের শ্রমিক ভাইবোনেরা কতখানি কষ্টে আছেন। তাদের এই কষ্টে শিল্পের প্রতিটি উদ্যোক্তা সমব্যাথী। প্রতিটি উদ্যোক্তা বিশ্বাস করেন, – শিল্প যতো সমস্যাতেই থাকুক না কেন, পোশাক পরিবারের সদস্য, – প্রতিটি শ্রমিক ভাইবোনদের সাধ্য অনুযায়ী ভালো রাখা উদ্যোক্তাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

আর তাই, শিল্পের আকাশে যখন অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে, তখন পোশাকখাতের শ্রমিক ভাইবোনদের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করার জন্য, পোশাকখাতে শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি নির্ধারনের জন্য বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আনন্দের বিষয় হলো, সরকার গঠিত নূন্যতম মজুরি বোর্ড নূন্যতম মজুরি পর্যালোচনা করে গতকাল ০৭ নভেম্বর ২০২৩ নূন্যতম মজুরি ১২,৫০০/- টাকা ঘোষনা করেছেন। নতুন মজুরি কাঠামো অনুযায়ী মজুরি ৫৬.২% বেড়েছে। অনেক উদ্যোক্তার জন্যই এই মজুরি দেয়াই কঠিন হবে।

আমরা গত ৩১ অক্টোবর ২০২৩ অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ঘোষনা দিয়েছিলাম, সরকার নতুন যে বেতনকাঠামো ঘোষনা করবে, আমরা পোশাক শিল্পের সকল উদ্যোক্তা সেটিই মেনে নিবো, শিল্পে যত প্রতিকূলতাই থাকুক না কেন। আমরা ঘোষিত মজুরি মেনে নিয়েছি। যত কষ্টই হোক, এই মজুরি বাস্তবায়ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নতুন মজুরি কাঠামো আগামী ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। পোশাক শ্রমিকদের জন্য নূন্যতম মজুরি বোর্ড নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষনা করার জন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পোশাক শিল্পের পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামোতে শ্রমিক ভাইবোনদের দাবী অনুযায়ী ৭টি গ্রেডের জায়গায় ৫টি গ্রেড করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়ানো বহাল রয়েছে। নতুন মজুরিতে মোট বেতনের তুলনায় মূল বেতন আনুপাতিকভাবে বেশি বাড়ানো হয়েছে। ফলে শ্রমিক ভাইবোনরা অনুপাতিকভাবে বোনাস ও অন্যান্য ভাতাগুলো বেশি পাবেন।

আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, নূন্যতম মজুরি বোর্ড নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষনা করার পর বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিক ভাইবোনরা ধর্মঘট করছেন, কারখানা ভাংচুর করছেন, যা অনভিপ্রেত।

শ্রমিক ভাইবোনদের প্রতি আমার অনুরোধ, এমন কিছু করবেন না যাতে করে শিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় – ক্রেতাদের আস্থা বিনষ্ট হয়। আপনাদের অবদানেই শিল্প বর্তমান পর্যায়ে আসতে পেরেছে। এমন কোন কাজ করবেন না,যাতে করে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারন ক্রেতারা শিল্প থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর আপনারা কর্মহীন হয়ে পড়বেন, যা কাম্য নয়।

দেশ ও শিল্পের স্বার্থে, শ্রমিক ভাইবোনদের কর্মসংস্থানকে সুরক্ষিত রাখতে, যদি কোন কারখানায় শ্রমিক ভাইবোনেরা কাজ না করেন, কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে যান, তবে মালিকরা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় কারখানা বন্ধ রাখতে পারবেন।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com