সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:২৪ অপরাহ্ন
সিনেমার ব্যবসা তো দূরের কথা, নিদেন দু’-এক সারি আসনে দর্শকই যদি না জোটে তবে এমন পরিস্থিতিতে সেই সিনেমা মুক্তি দিয়ে কী লাভ? এমন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে এখন ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছেন ঢাকাই চলচ্চিত্র নির্মাতারা। তাই যে পরিস্থিতি যাচ্ছে এমন অবস্থায় সিনেমা মুক্তি দেওয়ার চাইতে মুক্তি না দেওয়াই ভালোÑ এমনটিই মনে করছেন চলচ্চিত্র প্রযোজকরা।
এ ব্যাপারে প্রযোজক সমিতির সাবেক সভাপতি এবং দেশের অগ্রগণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক খোরশেদ আলম খসরু বলেন, ‘বর্তমান সময়টা খুবই খারাপ যাচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যেরকম টালমাটাল এই পরিস্থিতিতে থেকে নতুন সিনেমার শুটিংও সংকটে পড়ে গেছে। শুটিং করতে পারছে না সিনেমার ডিরেক্টররা। বেশ কয়টি সিনেমা মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল বছর শেষে।
সেগুলোরও মুক্তির তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি নিজেও চেয়েছিলাম মান্নার অসংখ্য ভক্তদের জন্য এ বছরের শেষে ১৫ ডিসেম্বর তার সর্বশেষ অভিনীত সিনেমা ‘জীবন যন্ত্রণা’ মুক্তি দিব। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে আমাকেও পিছিয়ে দিতে হলো। এখন এটা সামনের বছরের কোন মাসে মুক্তি দিতে পারব এটাও বলতে পারছি না। চলমান রাজনৈতিক কারণে দেশের সিনেমাকে আবারও একটা লম্বা সময়ের জন্য বড় একটা লসের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে।’
চলচ্চিত্র পরিচালক খোরশেদ আলম খসরুর মতো আরও অনেক প্রযোজকই এ বছরের শেষ তিন মাসকে তাদের সিনেমা মুক্তির টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে রেখেছিলেন। কারণ বছর শেষের এই সময়টাই সিনেমা মুক্তির জন্য সবচেয়ে উর্বর সময়। এই সময়ে দেশের আবহাওয়া, পরিবেশও থাকে বছরের অন্য সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। গরম ও বর্ষার মাসগুলো পেরিয়ে এ সময়ে একটা চমৎকার নাতিশীতোঞ্চ পরিবেশ বিরাজ করে। এমন নাতিশীতোঞ্চ পরিবেশে সিনেমা দেখার মজাই থাকে আলাদা। অন্যদিকে আছে বিজয়ের মাস, থার্টি ফার্স্টসহ নানা উপলক্ষ। বছরের দুটো ঈদ উৎসব ছাড়া যে সময়টা সিনেমা মুক্তির জন্য সবচেয়ে পছন্দের সেটা বছরের এই শেষ তিন মাসই। অথচ ঢাকাই সিনেমার জন্য এমন আরামদায়ক সময়টিই হয়ে ওঠেছে সিনেমা মুক্তির জন্য চরম বৈরী!
এমন বৈরী পরিবেশের শুরুতেই ১৩ অক্টোবর মুক্তি পেয়েছিল ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’। মাসজুড়ে দেশের সব কয়টি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হওয়া এই সিনেমাটি এখনো অনেক প্রেক্ষাগৃহে চলমান। প্রথম দু’সপ্তাহ সিনেমাটি দেখার জন্য দর্শক হলেও একপর্যায়ে রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশের জন্য দর্শক এ সিনেমাটি দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে উপচেপড়া ভিড়ের মতো উপস্থিত হয়নি। অনেক প্রেক্ষাগৃহে তো খুবই কম দর্শক হয়েছে। তারপরেও সিনেমা হলের মালিকরা এ সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করেছেন ইতিহাসের দায়বদ্ধতা থেকে। সেইসঙ্গে অন্য সিনেমার নির্মাতাদের অনেকে এই ইতিহাসের দায়বদ্ধতার প্রতি সম্মান জানিয়ে নিজেদের সিনেমা মুক্তি দেওয়া থেকে সরে আসেন। কেউবা পিছিয়ে দেন তাদের নির্ধারিত মুক্তির তারিখ। এই পিছিয়ে দেওয়া মুক্তির মিছিলে ছিল অরুণা বিশ্বাসের ‘অসম্ভব’, আরিফুর জামান আরিফের ‘যন্ত্রণা’ এবং ওয়ালিদ আহমেদের ‘মেঘের কপাট’। প্রথম বারের মতো ঢাকাই চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে অভিষিক্ত হওয়া আরিফুর জামানের ‘যন্ত্রণা’ সিনেমাটি মুক্তির তারিখ ছিল ২৭ অক্টোবর। কিন্তু ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ সিনেমার প্রতি সম্মান জানিয়ে তারা তাদের সিনেমার মুক্তির তারিখ পিছিয়ে পরিবর্তিত তারিখে মুক্তি দেয়। ওয়ালিদ আহমেদের ‘মেঘের কপাট’ও তাই। অরুণা বিশ্বাসের সিনেমাটিও একইভাবে তাদের নির্ধারিত মুক্তির তারিখ পিছিয়ে দিয়ে পরিবর্তিত তারিখে মুক্তি দেয়। কিন্তু মুক্তির পর দেখা গেল দুটো ছবিই সুপার ফ্লপ হয়। শুধু তাই নয়, এই সিনেমাগুলো মুক্তি পেলেও প্রেক্ষাগৃহও পেয়েছে নিতান্তই হাতে গোনা কয়েকটি। ‘মেঘের কপাট’ তো পায় মাত্র দুটো সিনেমা। ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাস এবং কেরানীগঞ্জে অবস্থিত লায়ন সিনেমা। এর মধ্যে অরুণা বিশ্বাসের ‘অসম্ভব’ সিনেমাটি কিছু বেশি অর্থাৎ ২০টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। তারপরেও সিনেমাগুলো দেখার জন্য দর্শক প্রেক্ষাগৃহে চোখে পড়ার মতো দেখা যায়নি। এরকম মারাত্মক বৈরী পরিস্থিতি দেখে পরবর্তীতে সব নির্মাতারাই বড়সড় ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায় তাদের সিনেমার মুক্তির নির্ধারিত তারিখ থেকে পিছিয়ে আসেন।
এখন আবার সেই সিনেমা মুক্তির তারিখ পিছিয়ে পড়েছেন আরেক উদ্ভূত সংকটে। চলতি বছর তো নয়ই, আগামী বছরের শুরু অর্থাৎ প্রথম তিন মাসেও মুক্তি দিতে পারবেন কিনা এমন আশঙ্কায় রয়েছেন। এ সময়েও রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশ তো আছেই তারপরে মার্চে আছে মুসলমানদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাস, রমজান। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতি সামনে রেখে আবার এদিকে নির্মাণাধীন ছবিগুলোর কাজও শেষ হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সিনেমা ছাড়পত্রও পেয়েছে। একদিকে মুক্তি প্রতীক্ষিত সিনেমা আরেকদিকে মুক্তি আসন্ন সিনেমা- সব মিলিয়ে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে এক কঠিন সিনেমা মুক্তির সেসনজটে পড়তে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কোনো সিনেমা শেষ পর্যন্ত মুক্তির আলোও দেখতে পারবে কিনা সংশয় রয়েছে। কারণ, এভাবেই ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে এমন অনেক ভালো ভালো সিনেমাও আছে, যেগুলো শেষপর্যন্ত মুক্তির আলোও দেখতে পায়নি কোনো দিন।
বর্তমানে এই মুক্তির সংকটে রয়েছে বেশ কিছু বহুল প্রতীক্ষিত কয়টি সিনেমা। এরমধ্যে রয়েছে গিয়াস উদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘কাজল রেখা’, রায়হান রাফী পরিচালিত ‘নূর’, সরকারি অনুদানে নির্মিত মানিক মানবিকের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ‘আজব ছেলে’, বদরুল আনাম সৌদ পরিচালিত ‘শ্যামা কাব্য’, বন্ধন বিশ্বাসের ‘ছায়াবৃক্ষ’, সরকারি অনুদানে নির্মিত জাকির হোসেন রাজুর ‘চাদর’, বদিউল আলম খোকনের ‘অফিসার’, অনম বিশ্বাস পরিচালিত ‘ফুটবল ৭১’, ওয়াজেদ আলী সুমনের ‘অন্তরাত্মা’, শুদ্ধমান চৈতন্য’র ‘দামপাড়া’, অরুণ চৌধুরী পরিচালিত ‘জ্বলে জ্বলে তারা’, ফুয়াদ চৌধুরী পরিচালিত ‘মেঘনা কন্যা’ প্রভৃতি।
এই সিনেমাগুলোর মধ্যে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা গেছে মানিক মানবিকের ‘আজব ছেলে’ এবং ফুয়াদ চৌধুরী পরিচালিত ‘মেঘনা কন্যা’ ১৭ নভেম্বর (কাল) মুক্তি পাচ্ছে। আর বদরুল আলম সৌদের ‘শ্যামা কাব্য’ মুক্তি পাচ্ছে ২৪ নভেম্বর। তবে এটাও মুক্তি পাবে কিনা অনিশ্চিত। কারণ, ওই তারিখে মুক্তি দেবেন কি দেবেন না এ নিয়ে এরইমধ্যে বদরুল আলম সংবাদ সম্মেলন করে জানাবেন বলেছেন।