সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:৫১ অপরাহ্ন

৭২-এ রুনা লায়লা

‘সত্যি কথা বলতে কি, কোনো আয়োজন থাকুক বা না থাকুকÑ জন্মদিন এলে আমার মনে বিচিত্র এক অনুভূতি কাজ করে। কাছের মানুষ, সহকর্মী, ভক্ত-অনুরাগী বিশেষ এই দিনটিতে আমাকে মনে করেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেক গুছিয়ে নানা রকমভাবে আমাকে নিয়ে লেখা লেখেন। আমাকে নিয়ে তাদের সেই সুন্দর লেখাগুলো আমি খুব মনোযোগ সহকারে পড়ি। কারও কারও লেখা একাধিকবার পড়ি। নিজের সম্পর্কে অবগত হই আমি। অনেকে আবার নতুন নতুন গানের জন্য অনুরোধ করেন। এটাও ভালোলাগার। শিল্পী হিসেবে নতুন গানতো আমি করতেই চাই। এখনতো আসলে আগের মতো সবসময় নতুন নতুন গান করা সম্ভব না। তবে আমি ভালো গীতিকবিতা যেমন পছন্দ করি , সুরটাও আমার ভালো লাগতে হবে। যদি দুটো বিষয় ব্যাটে-বলে মিলে যায়, তাহলে অবশ্যই গাইবো। যেমন গেল বছরের শেষ প্রান্তে কিন্তু আমি নতুন একটি দেশাত্মবোধক গান গেয়েছি। জন্মদিন এলে আব্বা-আম্মার কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে আমার বোন দীনা লায়লা’র কথা। সবাই আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন ভালো রাখেন, সুস্থ রাখেন।’

নিজের জন্মদিন প্রসঙ্গে এভাবেই লম্বা একটা বক্তব্য দিলেন ‘সুরের পাখি’ খ্যাত দেশবরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী রুনা লায়লা। বহুগুণের অধিকারী এই মহীয়সী নারী একাধারে অভিনেত্রী, কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার। তবে গায়িকা হিসেবেই এক নামে পরিচিত। তিনি নিজেও নিজেকে গায়িকা হিসেবে প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের অহঙ্কার, উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা আজ পা রাখলেন জীবনের ৭২তম বছরে। তবে বেশ কয়েক বছর ধরেই নিজের জন্মদিনকে ঘিরে বিশেষ কোনো আয়োজন রাখেন না দেশীয় সঙ্গীতের উজ্জ্বল এই নক্ষত্র। রুনা লায়লা জানান, করোনার সময় তো টানা দুই বছর ঘর থেকেই বের হননি তিনি। এমনকি একান্ত আপনজন ছাড়া কোনো গণমাধ্যমকর্মীদেরও নিজের বাসায় না আসার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু করোনা অনেকটা নিষ্ক্রিয় হওয়ায় স্বস্তির সঙ্গে জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। দিনটিতে তিনি পরিবারের সঙ্গেই আনন্দের মধ্য দিয়ে সময় কাটাবেন।

রুনা লায়লার কাছ থেকে জানা গেল, আজ তার জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও চ্যানেল আই তারকা কথনের বিশেষ পর্ব ‘আজ রুনা লায়লার জন্মদিন’ প্রচার করবে বিকাল ৪-২০ মিনিটে। অনন্যা রুমার প্রযোজনায় নানান আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে রুনা লায়লার জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ এই পর্বটি। এর আগে গত ১০ নভেম্বর রাজধানীর ব্লু-বেরি রেস্টুরেন্টে অনেকটা আনন্দঘন পরিবেশে আগাম জন্মদিন পালন করা হয় দেশের প্রথমসারির এই কণ্ঠশিল্পীর। সেখানে এই প্রজন্মের গায়ক-গায়িকা, অভিনেতা, উপস্থাপক’সহ আরও অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। রুনা লায়লার মতে, এমন করে এত সুন্দর আয়োজনের মধ্য দিয়ে অগ্রিম জন্মদিনও উদযাপন হয়নি তার জীবনে।

আজীবন সম্মাননাসহ একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্রে ভূষিত হওয়া গায়িকার কণ্ঠে সর্বশেষ প্রকাশিত মৌলিক গান ছিল ‘যদি প্রশ্ন করো কতোটা ভালোবাসি তোমাকে’ শিরোনামের একটি গান। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ও শফিক তুহিনের সুর করা গানটির সঙ্গীতায়োজন করেছিলেন ফুয়াদ নাসের বাবু। রুনা লায়লা জানান, এরই মধ্যে তিনি নতুন বেশকিছু গানেরও সুর করেছেন। আগামী বছর এ প্রজন্মের শিল্পীদের কণ্ঠে তার সুর করা এই গানগুলো তুলে দিতে চান। কণ্ঠশিল্পী থেকে সুরকার হিসেবে রুনা লায়লা প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন তার স্বামী আলমগীর পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ সিনেমায়। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আঁখি আলমগীর। এই সিনেমাতে সুর করে এবং গান গেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন রুনা লায়লা ও আঁখি আলমগীর দুইজনেই। ‘গল্প কথার ওই কল্পলোকে জানি’ শিরোনামের এই গানটি লিখেছিলেন দেশবরেণ্য গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার।

১৯৫২ সালের ১৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করা বহুমাত্রিক এই প্রতিভা বাংলাদেশে চলচ্চিত্র, পপ ও আধুনিক সঙ্গীতের জন্য বিখ্যাত। তবে বাংলাদেশের বাইরে গজল শিল্পী হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে সুনাম আছে তার।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই তিনি চলচ্চিত্রের গায়িকা হিসেবে কাজ শুরু করেন। ক্যারিয়ারের ৫৮ বছরে তিনি বাংলা ছাড়াও হিন্দি, সিন্ধি, আরবি, উর্দু, ফার্সি, পশতু, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, ইংরেজি, মালয়, নেপালি, জাপানি, স্পেনীয়, ফরাসি ও লাতিনসহ মোট ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। প্লে-ব্যাকে সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, পাকিস্তানের নিগার পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশে বহু সম্মাননা লাভ করেছেন তিনি। তবে নৃত্যশিল্পী থেকেই তার হওয়ার কথা ছিল। এ কারণে টানা চার বছর করাচির বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভরতনাট্যম, কত্থক, কত্থকলি শিখেছেন তিনি।

চলমান সময়ের অডিও বাজার এবং সিনেমা ও সিনেমার প্লে-ব্যাক নিয়ে রুনা লায়লা বলেন, ‘এখন তো গানের পরিবেশ যাচ্ছেতাই অবস্থা বিরাজ করছে। তবে সিনেমার গানে অনেকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। মাঝখানে তো মনে হয়েছিল সিনেমা হয় তো আর হয়ত ঘুরে দাঁড়াতেই পারবে না। এখন নতুনদের হাতে যে নতুন ঘরানার সিনেমা আসতে শুরু করেছে, এটার ধারাবাহিকতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সেটা যেমন দেশের সিনেমার জন্য মঙ্গল, প্লে-ব্যাকের জন্যও মঙ্গল। যদিও অনেকদিন ধরে প্লে-ব্যাক থেকে দূরে রয়েছি। তবে ভালো নতুন কোনো প্লে-ব্যাকের জন্য ডাক আসলে অবশ্যই গাইব।’ ‘শিল্পী’র পর আর কোনো নতুন সিনেমায় অভিনয় করবেন কিনাÑ প্রশ্ন শেষ করার আগেই উত্তর দেওয়া শুরু করলেন রুনা লায়লা। বললেন, কখনোই না। ওই একবারই নিজের ভালো লাগা থেকে অভিনয় করেছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম অভিনয় করাটা কত কঠিন কাজ। ওই ছবিটি আমার নিজের জীবনের ওপর ছিল বলেই না, শ্রদ্ধেয় চাষী নজরুল ইসলামের উৎসাহে অভিনয় করেছিলাম। তবে এই দুঃসাহস আর দ্বিতীয়বার দেখাতে চাই না। আমি সঙ্গীতশিল্পীÑ এটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়, এটাই আমার ভীষণ ভালো লাগার। এই ভালো লাগাটাই আমি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com