শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৮ পূর্বাহ্ন

বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল

অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি, পরিশোধন, বিক্রি ও মজুদ করার একক নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকলেও এবার তা বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করা দেওয়া হলো। সোমবার এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

দেশে জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ, এ খাতে দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি, যুগোপযোগী প্রযুক্তির ব্যবহার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতেই মূলত এ নীতিমালা করা হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। এসব কেন্দ্র থেকে অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে সরকার। পাশাপাশি অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন না করলেও তাদের বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ভর্তুকি বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তাকেও চড়া মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে।

অন্যদিকে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বিক্রি করছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন প্রতি মাসে পণ্যটির খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও তা কখনই মানছেন না এ খাতের ব্যাবসায়ীরা। তারা ইচ্ছেমতো দাম আদায় করছেন প্রকাশ্যে। দেশের ৯৮ শতাংশের বেশি এলপিজি সরবরাহ করছে বেসরকারি খাত। এক্ষেত্রে অনেক কম মূল্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের এলপিজি সরবরাহের সুযোগ থাকলেও চাহিদার তুলনায় এর সক্ষমতায় মাত্র দেড় থেকে ২ শতাংশ। তাছাড়া এই এলপিজি সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছায় না।

নতুন নীতিমালার বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার মতে এটা খারাপ হলো। বিশেষ করে তেলের ব্যবসাটা বেসরকারি খাতে দেওয়া উচিত না। আমাদের দেশে খুব সুন্দরভাবে এটা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। বাংলাদেশের মতো দেশে যদি বেসরকারি খাত জ্বালানি তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রি করে তাহলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। ভারত একটা বড় দেশ। ওদের অনেক রকম পণ্য রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সেদেশে সরকারও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে আমাদের দেশে এটার কোনো দরকার নেই।’

তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেলে যে চাহিদা ও সরবরাহ করা হয় সেজন্য এখন সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) রয়েছে। তারাই তো যথেষ্ট। পরিশোধনের জন্য যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান (ইস্টার্ন রিফাইনারি) রয়েছে তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। আরেকটি বড় বিষয় হলোঠান্ডা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের অন্তত কয়লা ও তেলের ব্যবহার থেকে সরে আসতেই হবে। সেটা চিন্তা করা হলেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। সব মিলে এটা আমাদের জন্য ভালো হবে না।’

ড. ইজাজ বলেন, ‘জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে এর মান ও দাম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই দরকার। সরকারের একক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পে সারা দেশে এক দামেও জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। দু-একটা ঘটনা বাদ দিলে এর গুণগত মান নিয়েও তেমন একটা সমস্যা নেই। এখন এটা বেসরকারি খাতে গেলে দাম নিয়ে নৈরাজ্যের পাশাপাশি তেলে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতাও বাড়তে পারে।’

তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকারের এই উদ্যোগের ফলে দেশে জ্বালানি তেলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হবে। এতে ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে মানসম্মত পণ্য পাবেন। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী বেসরকারি উদ্যোক্তারা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি ও পরিশোধন করে তা দেশব্যাপী পেট্রোল পাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দেবে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রমতে, অপরিশোধিত তেল আমদানি, পরিশোধন ও বিক্রি করতে আগ্রহী হয়ে ইতিমধ্যে পাঁচটি বেসরকারি কোম্পানি প্রস্তাব দিয়েছে।

বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭৫ লাখ টন। এরমধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধিত হয়ে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলসহ সরকারি বিপণন কোম্পানির মাধ্যমে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। সক্ষমতা বাড়াতে ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ স্থাপনের প্রকল্প নিচ্ছে বিপিসি, যা ২০২৭ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হবে। এটি হলে আরও ৩০ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করা সম্ভব হবে। বর্তমানে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়।

নীতিমালা অনুযায়ী, উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের জ্বালানি পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও প্ল্যান্ট পরিচালনায় ন্যূনতম ৩ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথবা এ সংক্রান্ত ন্যূনতম ৫ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিদেশি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি থাকতে হবে। রিফাইনারি স্থাপনে আগ্রহী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের গত ৫ বছরের মধ্যে যেকোনো ৩ বছরে প্রতি বছর টার্নওভার কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকা বা সমমূল্যের মার্কিন ডলার হতে হবে। এছাড়া কমপক্ষে ৮০ একর জমি ও রিফাইনারির অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ২ লাখ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন স্টোরেজ সুবিধা থাকতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বা তার  কোনো পরিচালক ঋণখেলাপি হতে পারবে না।

চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর আগে নিরাপত্তা গ্যারান্টি হিসেবে বিপিসির অনুকূলে বেসরকারি উদ্যোক্তাকে ২৫০ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হবে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর নিজস্ব মালিকানায় বা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লাইটারেজ জাহাজ, কোস্টাল ট্যাঙ্কার ও ট্যাংকলরি থাকতে হবে।

নীতিমালায় বলা হয়, বেসরকারি রিফাইনারিতে উৎপাদিত ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল বিপণন শুরুর প্রথম তিন বছর মোট উৎপাদিত জ্বালানি তেলের ৬০ শতাংশ সরকার-নির্ধারিত মূল্যে বিপিসিকে সরবরাহ করতে হবে। বাকি ৪০ শতাংশ জ্বালানি তেল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ও নিজস্ব নিবন্ধিত বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে। তবে বিক্রয় নেটওয়ার্কের স্বল্পতার কারণে কোনো বেসরকারি রিফাইনারি ৪০ শতাংশ তেল বিক্রি করতে না পারলে এর যেকোনো পরিমাণ বিপিসির কাছে বিক্রি করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে সরবরাহের ন্যূনতম ২ মাস আগে বিপিসিকে বিষয়টি জানাতে হবে। পরবর্তী দুই বছরে বেসরকারি রিফাইনারিগুলো তাদের উৎপাদিত তেলের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিক্রি করতে পারবে। বিপিসির চাহিদা না থাকলে সংস্থাটির অনাপত্তি গ্রহণ সাপেক্ষে বিদেশে পরিশোধিত জ্বালানি তেল রপ্তানিও করতে পারবেন বেসরকারি রিফাইনারি মালিকরা।

নতুন নীতিমালায় বলা হয়, বেসরকারি রিফাইনারি কর্তৃপক্ষ বিপণন কার্যক্রমে যুক্ত হলে বিপিসির জ্বালানি তেলের বাজার অংশীদারত্ব কিছুটা কমবে। কিন্তু বিপিসির পরিচালন ব্যয় অপরিবর্তিত থাকবে। এজন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেল বিপণনে বিপিসিকে প্রতি লিটারে ১ টাকা হারে সার্ভিস চার্জ প্রদান করবে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com