শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:৫৬ অপরাহ্ন

দুঃসময়ে টিভি নাটক

এক সময় পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে টিভি নাটক দেখা অনেকটা রুটিন ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে এটি এখন ড্রয়িংরুমে সীমাবদ্ধ নেই। ইউটিউবসহ বিভিন্ন অ্যাপে এখন নাটক দেখছে দর্শকরা। কিন্তু আজকাল কি হচ্ছে নাটকে? এমন প্রশ্ন প্রায়ই শোনা যায় দর্শকের কাছে। বিভিন্ন নাটকের ইউটিউব কমেন্ট বক্সেও দর্শকরা নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া জানান। দেশীয় নাটকের কুরুচিপূর্ণ নাম, অশ্লীল দৃশ্য ও সংলাপ এখন যেন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা সময় ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘অয়োময়’, বহুব্রীহি, ‘রূপনগর’, ‘শুকতারা’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আজ রবিবার’, ‘আমাদের নুরুল হুদা’, ‘রঙের মানুষ’, ‘দ্বিতীয়জন’, ‘সাকিন সারিসুরি’র মতো সুন্দর সুন্দর নামের নাটক তৈরি হতো। কিন্তু এখন কুরুচিপূর্ণ টাইটেলের নাটকে ভরপুর চ্যানেল থেকে শুরু করে ইউটিউব।

শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ইউটিউব ভিউর পেছনে ছুটতে গিয়ে নাটকে বাড়ছে অশ্লীলতা। অশ্লীল সংলাপ, পোশাক ও বিভিন্ন ধরনের সুড়সুড়ি দৃশ্য দিয়ে দর্শক আকৃষ্ট করার প্রতিযোগিতা চলছে। গল্প ও শিল্পীদের চরিত্রের চেয়ে বেশিরভাগ নির্মাতার টার্গেট এখন ইউটিউব ভিউয়ার্স। আর এই ভিউয়ার্স বাড়ানো প্রতিযোগিতায় মেতে তারা যাচ্ছেতাই নাটক নির্মাণ করছে। কিছু নাটকের নাম শুনলে মনে হবে না এগুলো কোনো সুস্থ চিন্তার ফসল। যেমন এক্স গার্লফ্রেন্ড, এক্স যখন শালি, এক্স এখন ভাবি, শালী যখন বউ, এক্স-এর হাতে অপারেশন, ক্রাশ যখন বেয়াইন, গার্লফ্রেন্ড শুধু খেতে চায়, জামাই আদর, আমি সিঙ্গেল, আইটেম বয়, পেইনফুল গার্লফ্রেন্ড, ছাত্রী যখন বউ, এক্স ওয়াইফ যখন আপন শাশুড়ি, গার্লফ্রেন্ড যখন অজ্ঞান, বান্ধবী যখন শাশুড়ি, প্লে-বয়, ফাউ গার্ল গার্লফ্রেন্ডের চাপ, বউ তো নয় যেন সিসি ক্যামেরা, বেড সিন, সেন্ড মি নুডস প্রভৃতি। নাটকগুলোর এমন নাম শুনে রীতিমতো বিস্ময় ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন নাট্যজনেরা। এ সময়ের কয়েকজন পরিচালকও এ ধরনের নামের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

অনেকে নাটকের এমন উদ্ভট ও অরুচিকর নামকরণকে পরিচালকদের সৃজনশীলতা ও শিক্ষার অভাবকে দায়ী করছেন। এছাড়া এসব নাটকে অনেক দর্শকপ্রিয় শিল্পীদেরও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখা যায়। বর্তমানে টিভি নাটকের চেয়ে ইউটিউবের জন্য যেসব নাটক নির্মাণ হচ্ছে সেগুলোতেই অশ্লীলতা বেশি দেখা যায়। ইউটিউব মুক্তবাজার। যে কারও স্বাধীনতা আছে এ মাধ্যমে কনটেন্ট নির্মাণ করার। এ মাধ্যমে নেই কোনো সেন্সরশিপ। ফলে নতুন নির্মাতারা এই সুযোগ নিচ্ছে বলে মনে করছেন নাট্যবোদ্ধারা। তারা মনে করেন, শুধু অভিনয় ও নির্মাণ করলেই চলবে না। শিল্পী ও নির্মাতাদেরও সমাজ এবং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। সমাজ ও তরুণদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এই ধরনের নাটকে অভিনয় থেকে শিল্পীদের দূরে থাকা উচিত। নির্মাতাদেরও ভালো নাটক নির্মাণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, তরুণ নির্মাতাদের মধ্যে এখন ভিউয়ের প্রতিযোগিতা চলছে। ভিউয়ের দিক থেকে এগিয়ে থাকতে হবে, এই মানসিকতা থেকে নির্মাতাদের বের হয়ে আসতে হবে। দর্শক অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট খায়, এমন ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ভালো কন্টেন্টে ভিউ কম হলেও তৃপ্তি থাকে একজন নির্মাতার। তাহলে নাটকে স্থিতিশীলতা আসবে।

এ বিষয়ে নাট্য পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি, অনন্ত হীরা বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরে সেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছি। এখন ৯৮ শতাংশ নাটকেরই বিষয়বস্তু প্রেম, অপরাধ, খুন, রক্তপাত আর যৌনতার স্থূল চিত্রায়ণ। আমাদের বর্তমান নাটক দেখলে মনে হয় প্রেম ছাড়া বা প্রেমজনিত সমস্যা আর কষ্ট ছাড়া কোনো বিষয় নেই। দেশ-মাটি-মানুষের যে সংকট, রুচির যে সংকট, মানবিক সম্পর্কের সংকটগুলো আর এখন আমাদের নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারছে না। আমাদের নাটক থেকে বাবা, মা, ভাই, বোন, আত্মীয়, বন্ধু চরিত্রগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এ বাস্তবতায় কিছুসংখ্যক নায়ক-নায়িকা ছাড়া অধিকাংশ গুণী শিল্পীর হাতে কাজ নেই। আমাদের টেলিভিশন ও ডিজিটাল মাধ্যমের নাটকে কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল দৃশ্যধারণ, অশ্লীল সংলাপের ব্যবহার এবং নাটকের নাম নির্বাচনেও রুচিহীনতা আর অশ্লীলতার আগ্রাসন একদিকে আমাদের নাটকের ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অন্যদিকে, আমরা উদ্বেগের সঙ্গে আশঙ্কা করছি, নাটকের ভিউ বাড়ানোর এই অসুস্থ অশ্লীল প্রতিযোগিতা আমাদের সামাজিক, পারিবারিক জীবনে সুস্থ রুচি, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিকাশের যে প্রয়োজনীয়তা, সেটাকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, টিভি চ্যানেলগুলো নাটক প্রচারের পর তা ইউটিউবে দিয়ে দিচ্ছে। ইউটিউবে যে নাটকটি বেশিবার দেখা হচ্ছে, সেটাও টেলিভিশনে প্রচার হচ্ছে। এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে ইউটিউব কনটেন্টের ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ম করা হয়েছে। ফলে সেখানে যা খুশি তা দেখানো সম্ভব নয়। অশ্লীলতা, কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট রুখতে হলে আমাদের দেশে এমন নিয়ম করা প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়। টাকাটা না পেলেই কিন্তু ইউটিউবের কুরুচিপূর্ণ প্রযোজনাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। তখন চ্যানেলগুলো আবার আগের ধারায় চলে আসবে। নাটকের এ দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই হয়তো এর সমাধান সম্ভব।’

প্রযোজক মনোয়ার পাঠান বলেন, ‘এখন নাটকে ও ওটিটিতে এমন কিছু সংলাপ ব্যবহার হয়, যেগুলো পরিবারের সামনে প্রকাশ্যে বলা যায় না। যে সংলাপ প্রকাশ্যে বলার মতো নয়, সেই সংলাপ কেন নাটকে আসবে? এই সমস্যা থেকে উত্তরণের দায় নাটকের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে নিতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ইউটিউবে কতটুকু দেখানো যাবে, তার একটা ন্যূনতম গাইডলাইন থাকা প্রয়োজন। এছাড়া আপত্তিকর কনটেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে এ প্রবণতা কমে আসবে।’

অভিনেত্রী নাজনীন হাসান চুমকী বলেন, ‘বর্তমানে আমরা আকাশ সংস্কৃতির মধ্যে আছি, যেটার মধ্যে কোনো সীমানা নেই। তার মানে কি আমরা আমাদের সংস্কৃতির বাইরে চলে যাব? আজ যে কনটেন্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেটা কি আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে? তার মানে আমরা সংস্কৃতি নিয়ে ভাবছি না। একটা সময় আমরা পরিবারের সবাই মিলে নাটক দেখতাম। সেই বিষয়টি এখন রূপকথার গল্পের দিকে চলে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এটি নিয়ে আমাদের ভাববার সময় হয়েছে।’ নাটক সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিমত, প্রতিযোগিতার নামে কোনো কোনো নির্মাতা কিংবা অভিনয়শিল্পী অকারণে এত বেশি খোলামেলা হচ্ছে যে, তা চোখে লাগার মতো। তারা খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। দেশের নাটক সুস্থভাবে তুলে ধরতে হলে এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com