সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৮ পূর্বাহ্ন
‘মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা যেমন দর্শক দেখেন না, তেমনি সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্রেও আগ্রহ নেই তাদের।’ দীর্ঘদিন ধরেই এমন মন্তব্য করে আসছেন চলচ্চিত্র পরিবারের অনেকেই। তাদের সঙ্গে সুর মেলাতে দেখা গেছে প্রেক্ষাগৃহ মালিকদেরও। যদিও তাদের সেই কথার বাস্তবায়ন দেখা গেছে গত কয়েক বছর ধরে। যারা তথাকথিত বাণিজ্যিক সিনেমা দেখে দেখে অভ্যস্ত, তারা রীতিমতো প্রত্যাখ্যান করেছে অনুদান ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি। দর্শকের অনীহার কারণে অনেকটাই বেকায়দায় পড়েন হল মালিকরা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে আপত্তি করেছেন তারা। এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো দেশাত্মবোধক ও অনুদানের ছবি মাত্র ৫টি এমনকী একটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। আবার এমনও হয়েছে, মুক্তির দুয়েকদিন পরেই দর্শকশূন্যতার কারণে সেসব সিনেমা নামিয়ে ফেলেছেন প্রদর্শকরা।
তবে গত দুয়েক বছরে এই দৃশ্যেও অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে চলতি বছরে যেসব দেশপ্রেমভিত্তিক ও অনুদানকেন্দিক সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক বেড়ে গেছে। আর ব্যবসায়িক সাফল্যের আশায় জনপ্রিয় তথাকথিত কমার্শিয়াল সিনেমার জনপ্রিয় তারকাদের নিয়ে সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। এই তালিকায় রয়েছেন, ফেরদৌস, রিয়াজ, পূর্ণিমা, শাকিব খান, সিয়াম আহমেদ, পুজা চেরীর মতো সময়ের চাহিদাসম্পন্ন তারকারা। পাশাপাশি খ্যাতিমান ও বরেণ্য তারকাদেরও রাখা হচ্ছে চরিত্রাভিনয় শিল্পী হিসেবে। এরইমধ্যে অনেকগুলো সিনেমার শুটিং শুরু হয়েছে, কোনোটা আবার রয়েছে মুক্তির অপেক্ষায়।
এদিকে চলতি বছরটিকে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমার বছর। ২০২৩ সালে এই ধারার অনেকগুলো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে; যেগুলো দর্শকের পাশাপাশি সুধীমহলেও প্রশংসিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও সৌরভ ছড়িয়েছে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতাও উঠে এসেছে এসব সিনেমায়। চলতি বছরের স্বাধীনতার মাস মার্চে মুক্তি পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চারটি সিনেমা। প্রথম সপ্তাহেই আলোর মুখ দেখে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত দুই সিনেমা ফাখরুল আরেফীন খানের ‘জেকে ১৯৭১’ ও খিজির হায়াত খানের ‘ওরা ৭ জন’। ভিন্ন ভিন্ন পেশা থেকে আসা সাত বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘ওরা ৭ জন’। পাশাপাশি আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়ে আসা ভারতের এক নারী চিকিৎসককে উদ্ধার করে আনার গল্পও তুলে ধরা হয়েছে সিনেমাটিতে। এতে অভিনয় করেছেন-জাকিয়া বারী মম, ইমতিয়াজ বর্ষণ, খিজির হায়াত খান, নাফিস আহমেদ, ইন্তেখাব দিনার, সাইফ খান, শাহরিয়ার ফেরদৌস সজীব, খালিদ মাহবুব তূর্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত প্রথম আন্তর্জাতিক সিনেমা ‘জেকে ১৯৭১’।
যুদ্ধ চলাকালীন শরণার্থী শিবিরে থাকা মানুষের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখা ফরাসি যুবক জ্যঁ ক্যুয়েরকে নিয়ে সিনেমা। শরণার্থীদের জন্য চিকিৎসা সামগ্রীর জোগান দিতে আস্ত এক বিমান ছিনতাই করেন জ্যঁ ক্যুয়ের। সেই সত্য ঘটনা অবলম্বনে সিনেমার নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গের শুভ্র সৌরভ দাশ। পাইলটের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। ১০ মার্চ মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত পঙ্কজ পালিত পরিচালিত ‘একটি না বলা গল্প’। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সন্তানকে সামনে রেখে একজন মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি সূত্রে উঠে আসে ১৯৭১। এতে প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন রওনক হাসান ও রুনা খান। ১৭ মার্চ আলোর মুখ দেখেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপটে তৈরি অনন্য মামুন পরিচালিত ‘রেডিও’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গণমানুষের কাছে তথ্য ও যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে রেডিও কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, তাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমায়। এতে অভিনয় করেছেন রিয়াজ আহমেদ, জাকিয়া বারী মম, নাদের চৌধুরী প্রমুখ।
মে মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তি পায় চিত্রনায়িকা অভিনীত ‘মা’। অরণ্য আনোয়ার পরিচালিত এই সিনেমাটি ১৯৭১ সালে কুমিল্লা অঞ্চলের এক সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে। নিজের সাত মাস বয়সি সন্তানের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি বীণাপাণি বড়ুয়া। সন্তানকে নিয়ে তার লড়াইয়ের গল্প তুলে আনা হয়েছে। এতে আরও অভিনয় করেছেন- আজাদ আবুল কালাম, ফারজানা ছবি, সাজু খাদেম, রোবেনা রেজা জুঁই, শিল্পী সরকার অপু, সেতু, লাবণ্য, শাহাদাত হোসেনসহ আরও অনেকেই।
চিত্রনায়িকা রোজিনার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘ফিরে দেখা’ মুক্তি পায় ১৬ জুন। ১৯৭১ সালে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া গল্প তুলে ধরেছেন তিনি। এর কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য রচনা করেছেন রোজিনা নিজেই। সিনেমাটিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন-রোজিনা, ইলিয়াস কাঞ্চন, নিরব, স্পর্শিয়াসহ আরও অনেকে। ‘১৯৭১ সেইসব দিন’ প্রেক্ষাগৃহে আসে ১৮ আগস্ট। প্রয়াত নন্দিত অভিনেতা ও নাট্যকার ড. ইনামুল হকের গল্প অবলম্বনে সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন তারই মেয়ে অভিনেত্রী ও নির্মাতা হৃদি হক। মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের একটি পরিবার এবং সেই সময়ের কিছু ঘটনা নিয়েই এই সিনেমার গল্প। এতে অভিনয় করেছেন- চিত্রনায়ক ফেরদৌস, মামুনুর রশীদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পী সরকার অপু, আবদুন নূর সজল, তারিন জাহান, লিটু আনাম, হৃদি হক, সাজু খাদেম, প্রীতি প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে উপজীব্য করে নির্মিত প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘মাইক’ মুক্তি পেয়েছে ১১ আগস্ট। এটি পরিচালনা করেছেন এফএম শাহীন। এতে অভিনয় করেছেন- ফেরদৌস আহমেদ, তানভীন সুইটি, তারিক আনাম খান, নাদের চৌধুরী, ঝুনা চৌধুরী, জয়িতা মহলানবিশ, সংগীতা চৌধুরী, রহিম সুমন, ইকবাল হোসাইন, শিশুশিল্পী সানজিদ রহমান খান প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব থেকে কিশোর বয়সের কাহিনি নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘দুঃসাহসী খোকা’। মুশফিকুর রহমান গুলজার পরিচালিত এই সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে আলো ছড়ায় ২৯ সেপ্টেম্বর। এতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌম্য জ্যোতি। এ ছাড়া আরও রয়েছেন লুৎফর রহমান জর্জ, ফজলুর রহমান বাবু, মাহমুদা মাহা, গোলাম ফরিদা ছন্দাসহ আরও অনেকে।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের ছোট গল্প অবলম্বনে নির্মিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘আজব ছেলে’ মুক্তি পায় ১৭ নভেম্বর।। মানিক মানবিক পরিচালিত এই সিনেমায় চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিদওয়ান সিদ্দিকী। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন তৌকীর আহমেদ, সাজু খাদেম, তাহমিনা অথৈ প্রমুখ। এক মা ও ছেলের গল্প হলেও যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তারা যেন অনুভব করতে পারে ওই সময়ে কত কী ঘটেছে; তার মধ্যে একটা নির্দিষ্ট কষ্টের কথা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে এই সিনেমার গল্পে।
সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর প্রেক্ষাগৃহে আসে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’। সিনেমার গবেষণা, কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ লিখেছেন সাজেদুল আউয়াল। এটি পরিচালনা করেছেন উজ্জল কুমার। এতে অভিনয় করেছেন- হামিদুর রহমান, জাহিদ হোসেন শোভন, আমিনুর রহমান মুকুল, কাজী রাজু, মাসুম বাশার, ফারজানা ছবি, আশরাফুল আশীষ প্রমুখ।
তবে বছরের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’। ১৩ অক্টোবর দেশের ১৫৩টি হলে মুক্তি পেয়ে রেকর্ড তৈরি করেছে। সিনেমাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব-কৈশোর থেকে শুরুর করে তার ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবন তুলে ধরা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তীকাল এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে সিনেমাটি। শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত এই সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন- নুসরাত ইমরোজ তিশা, ফজলুর রহমান বাব, নুসরাত ফারিয়া, রিয়াজ আহমেদ, দিলারা জামান, খায়রুল আলম সবুজ, তৌকীর আহমেদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, চঞ্চল চৌধুরী, সায়েম সামাদ, প্রার্থনা ফারদিন দীঘিসহ অনেকে।