বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৬ পূর্বাহ্ন

একজন কিংবদন্তির কথা বলছি…

হানাদারমুক্ত সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে যখন আনন্দের বান ছুটছিল তখন মুক্তিযুদ্ধ ফেরত এক তরুণ। এই আনন্দ ও মর্মন্তুদ বেদনার চিত্রটিকে কী করে চিরকালের রুপালি পর্দায় স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় এ নিয়ে একা একা এক নিভৃত কোণে ভাবছিলেন। তিনি সেই সময়ের টগবগে তরুণ মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকতেন ইকবাল হলে। স্বাধীনতার পর হলের নাম পরিবর্তন হয়ে হলো শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। তো, সেদিনের ইকবাল হলে ফিরে সোহেল রানা দেখেন সব নীরব থমথমে হয়ে আছে। দারোয়ান বলল, ‘আপনারা ফিরলেন, সব স্যার তো এখনো ফিরলো না’? সেই থমথমে মূর্তিটির সঙ্গে যেন আরো বেশি মোচড় দিয়ে উঠলো সদ্য যুদ্ধ ফেরত সোহেল রানার ভেতরটা দারোয়ানের কথায়। বললেন তিনি, ‘তখনই শহীদদের ত্যাগের গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণের ভাবনাটি মনের কোণে এসে গেল আমার।’

সোহেল রানা বলেন, ‘স্বাধীনতার পর আড্ডায় মুক্তিযুদ্ধের সময় কে কী করেছে তা নিয়ে আলাপ হতো। তখন মনে হলো, এই ঘটনাগুলো নিয়ে একটা সিনেমা করা যায়। মাসুম ইয়াহুদির লেখা আমার খুব ভালো লাগত। চাষীর সঙ্গে পরিচয় ছিল। সে তখন সহকারী পরিচালক। তাকে বললাম, একটা সিনেমা বানাতে চাই। মাসুম ইয়াহুদিকে বললাম একটা গল্প লিখে দেও, সিনেমা বানাব। ছোট ছোট গল্পকে মালা বানিয়ে দেবে।’ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর কথা চিন্তা করলেই তো হবে না, এত যেই সেই ক্যানভাসও নয়, এত টাকা আসবে কোত্থেকে? সোহেল রানার বাবা আবদুল মালেক ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। তার পেনশনের টাকার একটা অংশ ছেলের হাতে তুলে দেন মা দেলোয়ারা বেগম। বোন ফেরদৌস আরা বেগমের কাছ থেকেও হাজার দশেক টাকা নিয়েছিলেন প্রযোজক মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা। সেই শুরু, মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম সিনেমা ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণের গোড়ার কথা।

সোহেল রানা বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রির সবাই বিনা পারিশ্রমিকেই কাজ করতে চাইছেন। পরিস্থিতি এমন হলো, কাকে নেব আর কাকে বাদ দেব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’

কারণ, সবাই চাইছিলেন রুপালি পর্দার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে একটি দলিল হয়ে থাকতে। সেই ছবিতে সোহেল রানা যেমন ইন্ডাস্ট্রির পেশাদার অভিনয় শিল্পীদের নিলেন, অভিনয়ের বাইরে থাকা একেবারে সরাসরি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদেরও নিলেন। শুধু তাই নয়, ছবিটিতে পেশাদার অভিনয় শিল্পীদের ওপর প্রাধান্য ধরে রাখতেই প্রধান চরিত্রের জন্য বেছে নিলেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদেরই। আর এভাবেই অমুক্তিযোদ্ধা পেশাদার অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক হয়ে যান পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা আর সরাসরি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, যিনি ইতিপূর্বে কখনোই অভিনয় করেননি সেই শুশ্রƒষামণ্ডিত মুহম্মদ খসরু হয়ে যান কেন্দ্রীয় অভিনেতা।

সেদিনের তরুণ সোহেল রানা নিজেও প্রথম সিনেমার প্রযোজক হলেও মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি সিনেমা নির্মাণের চিন্তাভাবনায় যে তিনি কতটা সৃজনশীল তার ওই ছবিটিতে চরিত্র কাস্টিংয়েও বোঝা যায়। চরিত্র থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত যাবতীয় উপাদান সব কিছুতেই তিনি রিয়েলিটিকেই উপস্থাপন করলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমাটি দেখেছিলেন। ছবিটি দেখার পর তার অসম্ভব ভালো লাগা থেকে তিনি ছাত্রলীগের সবাইকে চা খেতে ডেকেছিলেন। সোহেল রানা সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘ভালোই তো বানাইছিস। এ লাইনেই থেকে যা।’

‘বঙ্গবন্ধুর কথামত আমি সিনেমাতেই থেকে গেলাম।’

যদি সোহেল রানা সিনেমায় আর নাও আসতেন তারপরেও এটা নিশ্চিত, ওই একটি সিনেমার জন্যই ইন্ডাস্ট্রির একজন হিসেবে তিনি কিংবদন্তি হয়ে থাকতেন। এটা শুধু বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বলেই নয়, ওই সিনেমাটি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যতটি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হয়েছে এখনো পর্যন্ত এই সিনেমাটিকেই সেরা সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলেও।

এ নিয়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, দেশ ও দেশের চলচ্চিত্র এবং নিজের ‘ওরা ১১ জন’ নিয়ে কথা হলে তিনি অনেক কিছুই বলেন। ‘ওরা ১১ জন’ এবং দেশের অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার কথা বলতে গিয়ে সোহেল রানা বলেন, ‘দেখেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর সিনেমা কোনটিকে বলবেন? ‘ওরা ১১ জন’ই তো! কিন্তু এরপর আরো যেসব সিনেমা হয়েছে সেগুলো কি ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার তুলনায় আসতে পারে? পারে না। আপনার প্রথম যে বাচ্চাটা হবে সেটা কি পরবর্তী সময়ে হওয়া বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনীয় হয়? হয় না।’

সেই ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার কিংবদন্তি এখন কেমন আছেন! কেমন কাটে তার জীবনযাপন? দীর্ঘদিন ধরেই সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন তিনি। যেমন সশরীরে তেমন কাজের মধ্য দিয়েও। তবে সর্বশেষ ‘গোয়িং হোম’ সিনেমায় দেখা গেছে তাকে। ছবিটি নির্মাণ করেছেন তারই ছেলে মাশরুর পারভেজ রায়ান। এটি ছিল মাশরুর পারভেজ নির্মিত দ্বিতীয় সিনেমা। চলতি বছরের ১১ আগস্ট ছবিটি মুক্তি পায়। এ ছবিটি দিয়েই দীর্ঘ ছয় বছর পর কামব্যাক করেন সোহেল রানা। এ ছবিটির প্রযোজনায়ও ছিলেন সোহেল রানা।

সেই ‘ওরা ১১ জন’ থেকে শুরু করে সর্বশেষ ‘গোয়িং হোম’ এ পর্যন্ত ‘মাসুদ রানা’, ‘বজ্রমুষ্টি’, ‘অদৃশ্য শত্রু’সহ প্রায় চল্লিশটি সিনেমায় প্রযোজনা করেছেন সোহেল রানা। আর অন্যের প্রোডাকশনে অভিনয় করেছেন আড়াই শতাধিক সিনেমায়।

একাধারে অভিনয়, সিনেমা পরিচালনা ও প্রযোজনায় সমান্তরালভাবে বিচরণ করা এই দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ২০১৯ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা লাভ করেন। পার্শ্বচরিত্রসহ তিনি তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ‘অজান্তে’সহ ১৯৮৩ সালে ‘লালু ভুলু’ সিনেমায় শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

তবে ব্যক্তিগতভাবে নিজের এত প্রাপ্তি সত্ত্বেও দেশ, জাতি ও ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যেন একেবারেই সন্তুষ্ট নন। বরং অনেকটাই হতাশ। চলচ্চিত্রের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কয়েক বছর আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন ‘এটা ডেড, এটা কবে আবার পুনরুজ্জীবিত হবে জানি না।’ হতাশ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী ঘটনাপরম্পরা তাকে বিচলিত করে।

বাংলা ভাষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সোহেল রানা বলেন, ‘দেখুন, পৃথিবীর প্রতিটি জাতিই নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নিজ ভাষাতে কথা বলেই তৃপ্ত ও গর্বিত। এজন্য আমাদের মতো তাদের আত্মত্যাগ ও লড়াইও কিন্তু করতে হয়নি। তারপরেও তাদের নিজ নিজ ভাষার প্রতি যে প্রেম ও শ্রদ্ধাবোধ আছে সেখানে নিজ ভাষার প্রতি আমাদের প্রেম ও শ্রদ্ধাবোধ কোথায়? বরং আমরা বাংলার চেয়ে ইংরেজিকেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করছি, সর্বত্র ইংরেজিকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। নিজের ভাষাকে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলছি। ইংরেজিটা কিন্তু শুদ্ধ ছাড়া অশুদ্ধভাবে বলার চিন্তাও করি না। বরং বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিলিয়ে এক ধরনের বাংলিশ করার প্রবণতা বাড়ছে আমাদের। আসলে জাতি হিসেবে আমরা খুবই হীনম্মন্য বলেই এমনটা হচ্ছে। এখন তো নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতেও লজ্জা করে আমার।’

এরপর তার সেই যুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতি সম্পর্কে কিছু বলতে বললে তিনি বলেন, ‘এখন আমি আমার যুদ্ধের সেই স্মৃতি থেকে এমন বলব, অনেকে যেমন টক শো’তে বলেন, যুদ্ধে তারা একেকজন মহাবীর আলেকজেন্ডার। তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, তারা যদি আলেকজেন্ডারই হবেন তাহলে সেই যুদ্ধে বিজয়ী হতে নয় মাস লাগলো কেন? ৩০ লাখকে কেন শহীদ হতে হলো? সেটা তো সাত দিনেই শেষ করে দেওয়া যেত! কিন্তু যুদ্ধটা সেরকম মহাবীর আলেকজেন্ডারের মতো হয়নি। আমাদের এ জন্য অনেক কাঠখড়ও পোড়াতে হয়েছে। পাকিস্তান আর্মি তো যুদ্ধের প্রথম তিন মাসেই গোটা বাংলাদেশ দখল করে নিল। এজন্য আমাদের আগে নিজেদের বাঁচিয়ে প্রথম চারমাসই গেছে যুদ্ধের জন্য যা যা লাগে তা সামলাতেই। আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে, বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছেন, ‘তোমাদের যার যা আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে’Ñ আমরা সেটাই করেছি। আমাদের তখন অস্ত্র বলতে ছিল পিস্তল, রাইফেল এসব। এগুলো দিয়ে তো যুদ্ধ করা যায় না। আমরা যুদ্ধ করেছি নিজেদের বাঁচিয়ে ‘হিট অ্যান্ড রান’ গেরিলা পদ্ধতিতে। কাজেই দিস ইজ নট ওয়ার। কিছু কিছু অংশে প্রথম তিনমাস সরাসরি যুদ্ধ করেছে আমাদের বাঙালি আর্মি, ইস্ট বেঙ্গল, বিডিআর (বাঙালি ইপিআর) তারা। তারপর আমরা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে বা দেশে কোথাও ট্রেনিং নিয়ে সম্মুখযুদ্ধ শুরু করি।’

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com