সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০৪ পূর্বাহ্ন
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের শহরতলীতে ম্যারিয়ট হোটেলে এ বছরের এপ্রিলে যে অনুষ্ঠান হয়েছে, সম্ভবত সেটি ছিল শয়তানের পূজারিদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন। শয়তানের উপাসনার আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য আলাদা করা ছিল একটি রুম, যেটিতে শুধু মোমবাতি জ্বলছিল। ঘরের এক কোনায় একটি বেদী আর মেঝেতে পেন্টাগনের চিহ্ন। এখানে যে আনুষ্ঠানিকতা পালন হয় সেটিকে বলা হয় ‘আনব্যাপ্টিসম’, অর্থাৎ খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার উল্টো প্রক্রিয়া।
শৈশবে ধর্মীয় দীক্ষা নেওয়ার সময় যেসব রীতি পালন করতে হয়, এখানে অংশগ্রহণকারীরা সেই রীতিগুলো প্রতীকীভাবে বর্জন করার অনুষ্ঠান পালন করে।
এখানকার সবার পরনেই ছিল গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা কালো আলখাল্লা, মাথায় হুড আর কালো মুখোশ। সবার হাতই ছিল দড়ি দিয়ে বাঁধা, যা পরে খুলে ফেলা হয় ‘মুক্তির’ প্রতীক হিসেবে। বিভিন্ন জায়গায় বাইবেলের ছেঁড়া পাতা রেখে বোঝানো হয়েছে খ্রিষ্টধর্ম থেকে বের হয়ে আসার শপথ।
‘স্যাটানিক টেম্পল’ বা শয়তানের মন্দিরকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকায় এর প্রতিনিধিও রয়েছে। এপ্রিলের শেষদিকে হওয়া এই সম্মেলনের টিকিট কিনেছিল ৮৩০ জন। এই আয়োজনের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘স্যাটান কন।’
এখানে আসা সদস্যরা বলছিলেন যে, তারা আসলে নরক থেকে আসা ‘লুসিফার’ বা শয়তানের ওপর আসলে বিশ্বাস করেন না। তাদের কাছে, শয়তান একটি প্রতীক, যার মাধ্যমে কর্তৃত্বকে, ধর্মকে প্রশ্ন করার বিষয়টি তুলে ধরা হয় এবং সবকিছুর পেছনে বিজ্ঞানের যুক্তির কথা বলা হয়। এখানে আসা মানুষের এই বিশ্বাসই তাদের ধর্মের ভিত্তি, বলছিলেন তারা। কারও নামকরণের সময় বা বিয়ে হলে তারা ধর্মীয় চিহ্নের বদলে শয়তানের চিহ্নকে পবিত্র হিসেবে ব্যবহার করে। অনেক সময় তারা উল্টো ক্রুশও ব্যবহার করে। তখন তারা কখনো কখনো ‘শয়তানের জয় হোক’ বলে সমস্বরে এর উদযাপন করে থাকে।
অনেক খ্রিষ্টানের কাছেই এটি গুরুতর ধর্মবিরোধিতা বা ব্লাসফেমি। শয়তানের মন্দিরের একজন মুখপাত্র ডেক্সের মতে তাদের ধারণা খুব একটা ভুল নয়।
তিনি বলেন, “আমাদের অনেকে উল্টো ক্রুশ পরে। আমাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাইবেল ছেঁড়া হয়, যার মাধ্যমে সমকামী ও নারীদের বিরুদ্ধে অত্যাচার, নিপীড়নের প্রতিবাদ বোঝানো হয়।”
“আর যারাই কোনো না কোনো ধরনের ধর্মীয় ট্রমা নিয়ে বড় হয়েছে, তাদের প্রতিও সহমর্মিতা প্রকাশ করা হয় এখানে।”
এখানকার শয়তানের উপাসকরা বলেন, তারা প্রত্যেকের নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালনের অধিকারকে সম্মান করেন। কারো মনে আঘাত দেয়া তাদের উদ্দেশ্য নয়।
তবে হোটেলের বাইরে বিভিন্ন মতবাদের খ্রিষ্টানদের উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়। তাদের হাতে ছিল নানা ধরনের ব্যানার, যেখানে অভিশাপ বাক্য আর ঈশ্বরের শাস্তির বাণী লেখা থাকতে দেখা যায়।
তাদের মধ্যে একজন বলছিলেন, “অনুতপ্ত হও আর ঈশ্বরের বাণীতে বিশ্বাস কর।” আরেকজনের দাবি, “শয়তান শুধু সমকামীদের জন্যই ঈশ্বরস্বরূপ।”
রক্ষণশীল ক্যাথলিক একটি গ্রুপের সদস্য মাইকেল শিভলার বলছিলেন, “আমরা ঈশ্বরকে বোঝাতে চাই যে এমন ধর্মবিরোধিতা আমরা মেনে নেব না। শয়তানের পূজারিদের জন্য ক্যাথলিকরা কোনো জায়গা ছেড়ে দেবে না।”
সম্মেলনে আসা শয়তানের উপাসকরা হোটেলের ভেতরে যাওয়ার সময় এই বিক্ষোভকারীদের দেখলেও তাদের সম্পর্কে হাসি ঠাট্টাই করতে দেখা গেল তাদের।
রাজনৈতিক সক্রিয়তা
স্যাটানিক টেম্পলের একটি অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ রাজনৈতিক সক্রিয়তা। তারা বিশ্বাস করে, ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা রাখা উচিত। এই লক্ষ্যে তারা প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আদালতে মামলাও করে থাকে। এই ক্ষেত্রে তাদের দাবিটা গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকাংশে যৌক্তিক হলেও অনেক সময়ই তাদের কার্যক্রম হাস্যরসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, ওকলাহোমা রাজ্যের ক্যাপিটল স্কয়ারে যখন বাইবেলের টেন কমান্ডমেন্টের স্ট্যাচু বানানো হয়, তখন তারা একটি আট ফিট লম্বা শয়তানের মূর্তিও সেখানে বসানোর দাবি তোলে। যুক্তি হিসেবে তারা যুক্তরাষ্টের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর উল্লেখ করে, যেখানে সব ধর্মকে সমানভাবে দেখার কথা বলা হয়েছে। আদালতে লড়াইয়ের পর সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত টেন কমান্ডমেন্টের স্ট্যাচু সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
এই মন্দির গর্ভপাতের পক্ষেও বেশ সোচ্চার। তারা বলেন, সবারই নিজের শরীরের ওপর পূর্ণ অধিকার থাকা উচিত। এ বছরের শুরুতে নিউ মেক্সিকোতে তারা একটি অনলাইন ক্লিনিকও খোলেন যেখান থেকে অনলাইনে গর্ভপাতের বড়ি সরবরাহ করা হয়। তাদের আরেকটি প্রকল্প বেশ আলোড়ন তৈরি করেছিল, সেটি হল ‘স্কুল পরবর্তী শয়তান ক্লাব।’ এই প্রকল্পের স্লোগান ছিল, ‘শয়তানের সাথে শিক্ষা।’ তাদের এই স্কুল পরবর্তী ক্লাব মূলত কমিউনিটি সেবার জন্য নিয়োজিত বলে তাদের দাবি।
এই ক্লাবে শিশুদের জন্য যে গান রয়েছে, সেই গানের কয়েকটি লাইন এমন: “শয়তান দুষ্ট কেউ নয়, সে শেখাতে ও প্রশ্ন করাতে চায়। সে চায় তোমরা ফুর্তি কর ও নিজেদের মত থাকো। আর নরক বলে কিছু নেই।”
শয়তান তোমাকে ভালোবাসে
“আমার মনে হয় আমি সব সময় শয়তানের সমর্থকই ছিলাম। এতদিন আমি শুধু এটা জানতাম না”, বলছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসা আরাসেলি রোহাস। তিনি বলেন, এই মন্দির সম্পর্কে তিনি প্রথমবার জানতে পারেন ২০২০ সালে, টিকটকের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, “প্রথম যখন আমি এটি দেখি, তখন একটু ভয় পেয়েছিলাম। আমি শুধু নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম যে তারা শিশুদের বলি দেয় না। পরে যখন তাদের সংষ্কৃতি জানা শুরু করলাম ও বৈঠকে যোগ দেয়া শুরু করলাম, তখন দেখলাম যে তারা আসলে ভালো মানুষ।” স্যাটানিক টেম্পল বলছে যে গত কয়েক বছরে তাদের সদস্য সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। কয়েক বছর আগে ২০১৯ সালেও যেখানে তাদের সদস্য ছিল আনুমানিক ১০ হাজার, সেখান থেকে এখন সাত লাখেরও বেশি মানুষ তাদের সাথে আছেন বলে দাবি তাদের।
বোস্টনের সম্মেলনে যারা গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী থেকে শুরু করে সার্কাসের পারফর্মারও রয়েছেন। এদের অনেকেই এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির সদস্য। আবার অনেকেই আছেন, যারা খ্রিস্টানদের সাথে বিবাহিত।
স্যাটানিক টেম্পলের সহ প্রতিষ্ঠাতা লুসিয়ান গ্রিভস যখন এই অনুষ্ঠানে প্রবেশ করেন তখন তার সাথে কয়েকজন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী ছিল। গ্রিভস (পরিবর্তিত নাম) প্রায় এক দশক আগে তার এক বন্ধু ম্যালকম জ্যারিকে (পরিবর্তিত নাম) নিয়ে এই সংগঠনটি তৈরি করেন। ধর্মীয় বন্ধন থেকে মুক্তি ও খ্রিস্টান ধর্মের রীতিনীতিকে আইনের সাথে জুড়ে দেয়া বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই সংগঠন তৈরি করেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো প্রায়ই এই সংগঠনকে খ্যাতি লোভী, তামাশার আশ্রয় নেয়া একটি দল হিসেবে উপস্থাপন করে। সংগঠনটি অবশ্য সবসময়ই এর কঠোর বিরোধিতা করে থাকে।
এই সংগঠনের অনেক সদস্যই জনসম্মুখে স্বীকার করতে পারেন না যে তারা এর সাথে যুক্ত। তারা মনে করেন এর ফলে তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে।
যেসব সদস্য জনসম্মুখে এটি স্বীকার করেছেন, তাদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, আদালতে নিজেদের সন্তানের হেফাজতের মামলা হেরেছেন, এমনকি নিজেদের গাড়ির নীচে বোমাও আবিষ্কার করেছেন।
স্যাটান কন চলাকালীন সময়েই সংগঠনের ধর্মীয় প্রজনন অধিকার ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র চার্লি ব্লাইথ অনলাইনে হয়রানির শিকার হন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাইবেলের পাতা ছেঁড়ার একটি ভিডিও প্রকাশ হলে তাকে অনলাইনে আক্রমণ করা হয়। এর আগে ২০১৬ সালেও এক বন্দুকধারী তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার বাড়ি পর্যন্ত হাজির হয়েছিল। তবে ব্লাইথ এই ধরনের হয়রানি ভোগ করতে গর্ব বোধ করেন।
তিনি বলেন, “আমার শত্রুরা যদি এমন অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসী মনোভাবের হয়ে থাকে যারা আমার অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায়, তাহলে আমি এমন শত্রু পেয়ে গর্বিত।”
আর এই গোষ্ঠীর মানুষ ভিন্নভাবে চিন্তা করে বলেই এদের সাথে যোগ দিয়েছেন টাইফন নিক্স। তিনি বলছিলেন যে, তিনি সম্প্রতি নাস্তিক থেকে শয়তানের উপাসক হয়েছেন।
তিনি বলেন, “যারা সবার চোখে অপাঙ্ক্তেয়, যারা ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারে- শয়তান তাদের প্রতিনিধিত্ব করে।”