বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৫:৫৪ অপরাহ্ন

একই গণ্ডিতে আটকা বাংলা গান

দেশের বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী বর্তমান সময়ের গানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এখন সবাই অর্থের মোহে ছুটছে। এখন কেউই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র মতো গান চর্চা করে না। আমি নাম বলতে চাই না, নামকরা শিল্পীরাও এখন অর্থের মোহে স্রোতে গা ভাসাচ্ছেন। এটা দেখে আমাকে খুব কষ্ট দেয়। কিন্তু কী করবে, তারও তো টাকা-পয়সার দরকার।’

কিন্তু এই ‘কষ্ট’ কি এক বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদীই বয়ে বেড়াবেন? এই কষ্ট কি গোটা জাতির নয়? যারা সুন্দর, শুদ্ধ গানের পিয়াসী তাদের নয়? দেশের আরেক শ্রোতাপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মনির খানসহ আরও অনেকেই বলছেন, দেশের গানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে মূলত বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের রিয়েলিটি শো’গুলোই। তাদের কারণেই আজ দেশে মৌলিক গানের চর্চা হচ্ছে না। তাদের কারণেই দেশে পরজীবী শিল্পীতে সয়লাব হয়ে গেছে বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় সঙ্গীতশিল্পীরা। যে কারণে মৌলিক গানের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। যা কিছু মৌলিক গান বলে দাবি করা হচ্ছে, তার বেশির ভাগ আবার অন্য জনপ্রিয় মৌলিক গানের অনুকরণ ছাড়া কিছুই নয়। এখন প্রতিটি টিভি চ্যানেল খুললেই দেখা যায় কীভাবে তারা রিয়েলিটি শো’য়ের নামে পরজীবী গানের আসর বসিয়ে জমিয়ে তুলেছে। সেইসঙ্গে নানা বাহারি অঙ্গভঙ্গি আর কলাকৌশলের মাধ্যমে পরজীবী শিল্পীদেরকে হাততালি দিয়ে বিপুলভাবে সমাদৃত করা হচ্ছে। এভাবে তারা বরং দেশের সৃজনশীল প্রতিভাকে অনুৎসাহিত করে অমৌলিক পরজীবী প্রতিভাকে উৎসাহিত করে আসছে।

দেখা যাচ্ছে প্রতিটি নতুন শিল্পীই অভিষেকে বেছে নিচ্ছেন পুরনো জনপ্রিয় কোনো গান। মৌলিক গান নয়। নতুন অনেক গানের দলও পরজীবী হিসেবে পুরানো গান কভার করে আলোচনায় আসছেন ও গানকে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে উঠে আসা শিল্পীদেরও দেখা যায় মৌলিক গানের চেয়ে প্রচলিত কোনো গান কভার করতেই বেশি আগ্রহী। বিভিন্ন টিভি শো, ইউটিউব, স্টেজ শো’সহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেও বেছে নেন পুরনো গানকেই।

যারা প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, গুরুমুখী বিদ্যার মাধ্যমে গানকে অনুশীলন করেছেন তারা মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে বাংলা গানের সৃজনশীলতাই বাধাগ্রস্ত হবে। এ দেশে একজন শিল্পীকে তৃণমূল থেকে তুলে আনার কাজটি শুরু করে যারা তার মধ্যে অন্যতম ‘ইত্যাদি’। সেটাও মৌলিক গানের শিল্পী হিসেবে নয়। পরজীবী গানের শিল্পী হিসেবেই। তবে চ্যানেল আই ‘ক্লোজ আপ ওয়ান’ নামের প্ল্যাটফর্ম থেকে এই পরজীবী শিল্পী চেনানোর কাজটি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে শুরু করে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে বহু রিয়েলিটি শো আছে। এনটিভি, আরটিভি, জিটিভি’র সারেগামাপাসহ বহু প্ল্যাটফর্ম রিয়েলিটি শো’য়ের আয়োজন করছে। চ্যানেল আইয়ের প্রতিযোগিতায় প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন নোলক বাবু এবং সালমা আক্তার। সেই শুরু, এরপর থেকে চলছেই।

তবে নোলক বাবু এবং সালমা আক্তার প্রথমে অমৌলিক গানের শিল্পী হিসেবে শুরু করলেও একপর্যায়ে তারা মৌলিক গানের শিল্পী হিসেবে নিজেদের প্রমাণ দিতে সক্ষম হন। যারা ধারাবাহিকভাবে মৌলিক গান গাইতে পারেননি তারাই হারিয়ে গেছেন বা হারিয়ে যাচ্ছেন। যেমন ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয় হওয়া ‘কৃষ্ণ’ গানের শিল্পী কায়া কালের স্রোতে হারিয়ে গেছেন মৌলিক গান দিতে না পেরে। আবার অনেককে দেখা গেছে সারা জীবনই অমৌলিক পরজীবী শিল্পী হিসেবেই থেকে গেছেন। যিনি সারা জীবনই পরজীবী হিসেবে থেকে গেছেন তাকে কিভাবে শিল্পী বলা যাবে! সবচেয়ে বিস্ময়কর, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক আসর থেকে যারা চ্যাম্পিয়ন, রানারআপ হয়ে আসছেন সেটা কারা নির্বাচন করছেন? যারা শোগুলোতে চোখ রাখেন, দেখবেন- বিচারকমণ্ডলীতে আলো করে বসে আছেন সেলিব্রিটি কণ্ঠশিল্পীরাই। সেখানে গানের নামজাদা শিক্ষক বা উস্তাদদের কাউকেই পাওয়া যাবে না। তখন দেখা যায়, দর্শকদের তরফ থেকেই অভিযোগ ওঠে অমুককে চ্যাম্পিয়ন করা ঠিক হয়নি তমুক করা উচিত ছিল- এরকম অভিযোগ। এরকম নানা পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠে শো’কে কেন্দ্র করে। এমনকি অর্থব্যয়ের অভিযোগও ওঠে। ফলে বিচারকদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

তাতেই বোঝা যাবে, রিয়েলিটি শো’গুলো বাংলা গানের উন্নয়নের স্বার্থে কিছু করছে না বরং বারোটাই বাজিয়ে দিচ্ছে একের পর এক পরজীবী শিল্পী মাঠে ছেড়ে। এটা বাংলাদেশেই নয়, কলকাতাতেও চলছে। সেখানে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের অমৌলিক পরজীবী শিল্পীরাও সমাদৃত হচ্ছেন। এভাবে রিয়েলিটি শো’ যেসব শিল্পী আনছে তারাও ছড়িয়ে পড়ছে দেশের কেন্দ্র শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্টেজ শোগুলোতে। স্টেজ শো’তেও যত গান গাওয়া হয় সবই পরজীবী গান। পুরানো জনপ্রিয় গানেই কণ্ঠ দিচ্ছেন এই শিল্পীরা। এরমধ্যে যেমন আধুনিক গান আছে পাশাপাশি দেশাত্মবোধক থেকে শুরু করে র‌্যাপ, পপ, লোকগানসহ সব ধরনের গানই আছে।

বর্তমানে অমৌলিক পরজীবী শিল্পী হিসেবে যারা নাম কুড়িয়েছেন মঈনুল আহসান নোবেল, ইলিয়াস হোসাইন, আরমান আলিফ, মমরোজ মাহমুদ, জাহিদ অনিক, সিমা সরকার, মাহতিব শাকিব, তবীব মাহমুদ, প্রমিত কুমার, টুম্পা খান, কামরুজ্জামান রাব্বি প্রমুখ।

এমন নয়, নতুনরা একেবারেই নতুন গানে কণ্ঠ দিচ্ছেন না। প্রতিনিয়তই শত শত নতুন গান প্রকাশ হচ্ছে। তবে তার সিকিভাগও আলোচনায় আসে না, শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যেতে পারছে না। ফলে নতুনদের মধ্যে এমন শিল্পীও খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা মৌলিক গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন। তখন বাধ্য হয়েই একের পর এক পুরনো গানেই পরজীবী হিসেবে কণ্ঠ দিতে হচ্ছে তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরজীবী হলেও তারা একেকটি স্টেজ শো থেকে সম্মানীও কম পান না। পঞ্চাশ হাজার থেকে শুরু করে অনেকে দুই তিন লাখ টাকা পর্যন্ত পান। জানা যায়, লোকগানের জন্য একজন শিল্পী ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পান। আধুনিক, পপ প্রভৃতি গানে এক থেকে তিন চার লাখ টাকা পর্যন্ত পান।

বড় বাস্তবতাটি হলো, জনপ্রিয়তার দিক থেকে এখনও পুরনো গানগুলোই প্রচণ্ডভাবে এগিয়ে আছে। এই শিল্পীদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। অনেকের বয়সও হয়ে গেছে। সে কারণে তাদের স্টেজ শো-এর আয়োজকরাও ডাকেন না। বরং তাদের গাওয়া গানগুলোই তালিকা করে নতুন শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ান। এটা করেন মূলত ব্যবসায়িক স্বার্থে। মঞ্চে নতুন মৌলিক গান স্টেজ শো’তে গাইয়ে ঝুঁকি নিতে চান না আয়োজকরা। এভাবে শো’তে জনপ্রিয় গান মূল কণ্ঠশিল্পীদের গলায় না শুনিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাচ্ছেন নতুন শিল্পীদের দিয়ে। এভাবেও প্রমাণিত হয়, পুরানো হলেও এখনো সে গান দাপটের সঙ্গেই টিকে আছে পরজীবী কণ্ঠশিল্পীদের কণ্ঠে। কিন্তু যে গান মৌলিক নয়, অন্যের কণ্ঠে গীত গান- সেই গান গেয়ে একজন শিল্পী যদি তিন/চার লাখ টাকা পর্যন্ত নিতে পারেন সেখানে মৌলিক গানের কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, গীতিকার, গীতিকবি তারা বা তাদের উত্তরসূরিরা কি তা থেকে কিছুই পাবেন না!

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com