মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১৮ অপরাহ্ন

টিকার ডিসেম্বর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয়

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই করোনা টিকার লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক পূরণ করতে চায় সরকার। মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিসাবে ১৩ কোটি ৫২ লাখ ৮৮ হাজার মানুষকে পূর্ণ টিকা (দুই ডোজ) দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সেই লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক পূরণ করতে হলে ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৪৪ হাজার মানুষকে পূর্ণ (দুই ডোজ) টিকার আওতায় আনতে হবে। অন্যদিকে, ডিসেম্বরের মধ্যে মোট লক্ষ্যমাত্রার ৪০ শতাংশ পূরণ করতে চায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে হিসাবেও আগামী দুই মাসের মধ্যে মোট ৫ কোটি ৪১ লাখ ১৫ হাজার ২০০ মানুষকে দুই ডোজ টিকা দিতে হবে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সংশয় দেখা দিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী দুই মাসে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হয়ে যাবে। কারণ হিসেবে তারা টিকাদানের গতি, টিকার মজুদ ও সরবরাহকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন।

টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে মোট টিকা দেওয়া হয়েছে ৬ কোটি ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৩৩ ডোজ। এর মধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৪ কোটি ৬ লাখ ২৭ হাজার ৬৮৮ ও দ্বিতীয় ডোজ ২ কোটি ৮ লাখ ৬২ হাজার ৬৫। কিন্তু এখন পর্যন্ত (২৫ অক্টোবর) পূর্ণ টিকা পেয়েছেন ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ মানুষ। এখনো ৩৫ শতাংশ মানুষ দ্বিতীয় ডোজ পাননি। এসব মানুষকে পূর্ণ টিকার আওতায় আনতে হলে আগামী দুই মাসে ৭ কোটি মানুষকে সম্পূর্ণ টিকা দিতে হবে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ দিতে হবে ৩ কোটি ও দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে ৪ কোটি মানুষকে।

একইভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৪০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও সংশয় রয়েছে। টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে ৪০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে ডিসেম্বরের মধ্যে পূর্ণ টিকা দিতে ৫ কোটি ৬০ লাখ ডোজ টিকার প্রয়োজন হবে এবং লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে মাসে আড়াই কোটির বেশি টিকা দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান টিকার মজুদ, সরবরাহ ও টিকাদানের গতি অনুযায়ী এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

টিকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান করোনার টিকা বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকাদান কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক। তিনি গতকাল মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অর্ধেক না, লক্ষ্যমাত্রার  জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশকে পূর্ণ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যামাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা না থাকলে এগোনো যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি ৪০ শতাংশ মানুষকে দেওয়ার। সেটা বেশিও হতে পারে, কমও হতে পারে। সবকিছুই নির্ভর করবে টিকা সরবরাহের ওপর। আমাদের প্রস্তুতি আছে।’

দুই মাসে দিতে হবে ৭ কোটি টিকা: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত এক মাসে (২৫ সেপ্টেম্বর-২৫ অক্টোবর) টিকা দেওয়া হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে ২ কোটি ১২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৪। এর আগের মাসে (২৫ আগস্ট-২৫ সেপ্টেম্বর) দুই ডোজ মিলে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৭ হাজার ২১১ ডোজ। অর্থাৎ সর্বশেষ এই দুই মাসে মোট টিকা দেওয়া হয়েছে ৩ কোটি ৬৭ লাখ ৪৫ হাজার ৩৭৫ ডোজ। সে হিসাবে ওই দুই মাসে মাসিক গড় টিকার পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৮৩ লাখ ৭২ হাজার ৬৮৭ ডোজ। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে ৭৫ লাখ টিকার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে দুই দিনে দেওয়া হয় ৮০ লাখ টিকা। এই গণটিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। এভাবে টিকা দেওয়া হলে আগামী দুই মাসে, অর্থাৎ নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ৪ কোটি টিকা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে ডিসেম্বরের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক, অর্থাৎ ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৪৪ হাজার মানুষকে পূর্ণ (দুই ডোজ) টিকার আওতায় আনার।

টিকার তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বর্তমানে যে হারে টিকা দিচ্ছে, সেভাবে টিকা দিতে থাকলে ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর টিকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে আরও চার মাসের বেশি সময় লাগবে।

অন্যদিকে, টিকার বর্তমান মজুদ ও সরবরাহ গতির কারণেও ডিসেম্বরের মধ্যে অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনাও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন (২৫ অক্টোবর) পর্যন্ত চার ধরনের মোট টিকা এসেছে ৭ কোটি ৭০ লাখ ৭২ হাজার ৪২০ ডোজ। এর মধ্যে ৬ কোটি ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৩৩ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এই মুহূর্তে টিকা মজুদ আছে ১ কোটি ৫৫ লাখ ৮২ হাজার ৬৬৭ ডোজ। সে হিসাবে আগামী দুই মাসের মধ্যে টিকার প্রয়োজন হবে আরও সাড়ে ৫ কোটি ডোজ। অথচ গতকাল চীন থেকে কেনা সিনোফার্মের আরও ২ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে।

টিকার সরবরাহের ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে চুক্তি অনুযায়ী চীন থেকে ২ কোটি টিকা ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে আরও ১ কোটি মোট ৩ কোটি টিকা আসার কথা। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ২০ অক্টোবর গণমাধ্যমকে জানান, চীনের সিনোফার্মের টিকা চুক্তি অনুযায়ী চলে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে চুক্তি অনুযায়ী আরও টিকা আসা শুরু হয়ে গেছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকাও চলে আসছে। কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিজের আওতায় ফাইজার, মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাও দেশে আসছে।

পূর্ণ টিকা পেয়েছেন ১৫ শতাংশ মানুষ: বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২০ অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১০ হাজার। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩ কোটি ৫২ লাখ ৮৮ হাজার মানুষকে টিকা দেবে সরকার। এই লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে গত সাড়ে ৮ মাসে সরকার পূর্ণ টিকা (দুই ডোজ) দিতে পেরেছে ২ কোটি ৮ লাখ ৬২ হাজার ৬৫ জনকে, যা মোট জনগোষ্ঠীর (৮০ শতাংশ হিসাবে) মাত্র ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ।

একইভাবে এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৪ কোটি ৬ লাখ ২৭ হাজার ৬৮৮ জন, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় মিলে সরকার টিকা দিতে পেরেছে ৬ কোটি ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৩৩ ডোজ।

আগামীকাল গণটিকার দ্বিতীয় ডোজ: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর সারা দেশে যে বিশেষ কভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে দ্বিতীয় ডোজের কার্যক্রম ২৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে। সেদিন সারা দেশে সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলায় টিকার দ্বিতীয় ডোজ পাবেন মানুষ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও জানায়, ওই দিন কেবল দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া হবে। প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ থাকবে।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর সারা দেশে এক দিনে ৭৫ লাখ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেয় সরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেদিন দিতে পেরেছে ৬৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৮২ ডোজ। অবশ্য পরের দিন সাধারণ টিকাদান কর্মসূচির পাশাপাশি গণটিকার অংশ হিসেবে ৮০ লাখ টিকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে সরকার।

এ ব্যাপারে ডা. শামসুল হক গতকাল মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, বৃহস্পতিবার (আগামীকাল) এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। এক দিনে ৭৫ লাখ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। কেউ বাদ পড়লে তিনি পরে নিতে পারবেন।

স্কুল শিক্ষার্থীদের টিকা আগামী সপ্তাহেই: আগামী শনি বা রবিবার ১২-১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের করোনা টিকা দেওয়া শুরু করতে পারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ব্যাপারে প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, নিজ নিজ স্কুলের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। সক্ষমতা অনুযায়ী সারা দেশের জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে ২১টি কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে স্কুলশিক্ষার্থীদের ফাইজারের টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। স্কুলশিক্ষার্থীদের তালিকা সরবরাহ করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অধিদপ্তর সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মে তাদের বিস্তারিত তথ্য দেবে।

এ ব্যাপারে ডা. শামসুল হক বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যত দ্রুত দেওয়া যায়। খুব তাড়াতাড়ি তারিখ জানাতে পারব।’

এর আগে ১৪ অক্টোবর মানিকগঞ্জের চার সরকারি স্কুলের ১১১ জন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষামূলকভাবে করোনা টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়। তাদের পর্যবেক্ষণ শেষে সারা দেশে পর্যায়ক্রমে স্কুলশিক্ষার্থীদের এই টিকা দেওয়ার কথা।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com