শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৪২ অপরাহ্ন

নায়িকা থেকে দাদি মা, কেমন আছেন আনোয়ারা?

‘আনোয়ারা’ নামে মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য রত্নের ব্রিটিশ আমলে লেখা একটি বিখ্যাত কালজয়ী উপন্যাস আছে। খুব কম পাঠকই আছেন, যে এটি পড়েননি। প্রায় প্রতিটি বিয়ের অনুষ্ঠানে বইটি উপহার দেওয়া হতো। সেই একই নামের বাংলা সিনেমার আনোয়ারা তো জীবন্ত কিংবদন্তি হয়েই আছেন।

দর্শকের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি বলতে পারবেন আনোয়ারার হৃদয়স্পর্শী অভিনয়ও তাকে আকর্ষণ করেনি। পুরো নাম আনোয়ারা জামাল। বাবা জামাল উদ্দিনের জামাল নামটি নিয়ে হয়েছেন আনোয়ারা জামাল। কিন্তু দর্শকের সবাই তাকে আনোয়ারা নামেই চেনেন ও ভালোবাসেন।

ছয় শতাধিক চলচ্চিত্রের আনোয়ারা এত চরিত্রে অভিনয় করেছেন যে, দিন শেষে অধিকাংশ সিনেমাতেই নায়িকার চরিত্র নয়- আনোয়ারার হৃদয়স্পর্শী অভিনয়ই বেশি স্মরণে রেখেছেন দর্শক। ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’র ‘আলেয়া’ চরিত্রটিতে যে অনবদ্য অভিনয় করেছেন- সে তো কিংবদন্তিই হয়ে আছে। আনোয়ারা অসংখ্য মঞ্চ নাটকসহ টেলিভিশন নাটকেও অভিনয় করেছেন। মঞ্চে ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ ছাড়াও ‘মায়ের কান্না, ‘আমির আকরাম’ নাটকে অভিনয় করেছেন।

অনেক নায়িকাই আছেন বয়স যত গড়িয়েছে ততই যেন চলচ্চিত্র থেকে ছিটকে পড়ার সময় মাপতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আনোয়ারাই একমাত্র অভিনেত্রী বয়স যত বেড়েছে ততই তার অভিনয়ের পরিপক্কতা ও ক্ষুরধারত্ব বেড়েছে। সিনেমাগুলোতে ভাবি, চাচি, শাশুড়ি ও মায়ের চরিত্রেই বেশি উপস্থিত হয়েছেন। ১৯৮৪ সালে ‘দাদি মা’র ভূমিকায় ‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রেও যে অনবদ্য অভিনয় করেছেন সেটাও তার ক্যারিয়ারে একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে। এছাড়া ‘দাদি মা’ নামের আরেকটি চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয়ও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ অবস্থায় ‘দাদি মা’র পরে আর কোনো চরিত্র থাকতে পারে যেখানেও তার অনবদ্য অভিনয়ের স্বাক্ষর রাখবেন? সেই অনবদ্য অভিনেত্রী এখন বার্ধক্যজনিত কারণে অভিনয় থেকে দূরে।

এ অবস্থায় কোন চরিত্রেই বা অভিনয় করা যায়! তার ওপর ঢাকাই সিনেমায় থেকেও সেই বৈচিত্র্যমুখী চরিত্রগুলোও ছেটে ফেলা হচ্ছে একে একে। তাতে আনোয়ারার বিকল্প অভিনেত্রী আসবেন সে তো সুদূর পরাহত। আর মায়ের চরিত্রে আনোয়ারা এক কথায় অপ্রতিদ্বন্দ্বীই।

একজন নির্মাতা কী চান খুব সহজেই বুঝে ফেলতে পারেন আনোয়ারা। ফলে কোনো নির্মাতাকেও লাইট ক্যামেরার সামনে তার কোনো শট ‘ওকে’ বলতে বেগ পেতে হয় না। এতটাই চরিত্রানুগত সহজাত শিল্পী তিনি। ক্যারিয়ারে ৮ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারই তার সেই স্বীকৃতি। এর মধ্যে সেরা পার্শ্বচরিত্র ছাড়াও ‘সেরা অভিনেত্রী’ হিসেবে পুরস্কারও আছে। এ ছাড়া ২০২০ সালে তাকে আজীবন সম্মাননা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করা হয়।

প্রথমে নৃত্যশিল্পী হিসেবে ফজলুল হক পরিচালিত ‘আজান’ সিনেমায় অভিষেক হওয়া আনোয়ারা কিছু ছবিতে নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। পরে সহ-নায়িকা বা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। ‘আজান’ অভিষেক সিনেমা হলেও নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা কিংবদন্তি আবদুল জব্বার খানের ‘নাচঘর’।

১৯৬৪ সালে কিংবদন্তি পরিচালক জহির রায়হানের ‘সংগম’ চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো সহ-নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন। মাঝে কয়টি সিনেমায় পূর্ণ নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৯৬৫ সালে ‘জানাজানি’ সিনেমায় তার বিপরীতে নায়ক ছিলেন শওকত আকবর। এরপর ১৯৬৭ সালে উর্দু সিনেমা ‘বালা’তে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন। তার বিপরীতে নায়ক ছিলেন হায়দার শফি।

এরপরই মূল আনোয়ারা উপাখ্যানের শুরু। পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ সিনেমায়। যা তার গোটা জীবনেরও মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তৎকালীন গোটা পাকিস্তানজুড়ে চলচ্চিত্রটি এক অভাবনীয় ব্যবসায়িক সফলতা লাভ করে। ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে চলচ্চিত্রটি উর্দুতেও চিত্রায়িত হয়। আনোয়ারার জনপ্রিয়তা রাতারাতি গোটা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে যায়। এরপরে অসংখ্য বার ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’র মঞ্চায়ন হয়েছে। ‘আলেয়া’ চরিত্রে আনোয়ারাই ছিলেন অবিকল্প। কেননা, এমন কোনো অভিনেত্রীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি যেখানে কেউ আনোয়ারার বিকল্প হতে পারেন।

‘আলেয়া’ চরিত্রেই নয়, ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির রমরমা অবস্থাতেও আনোয়ারার বিকল্প কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই তো তার চলচ্চিত্রের সংখ্যাও এত বেশি- ছয় শতাধিক। বাংলা ভাষায় ছাড়াও বেশ কিছু উর্দু সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন তিনি।

‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ ছাড়াও আনোয়ারার আরও ৩টি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ১৯৮২ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেবদাস’ ও ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শুভদা’। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রে তার ‘ময়না বু’ চরিত্রের অনবদ্য অভিনয় আজও দর্শকের হৃদয়ে আঁচড় কেটে যায়। সিনেমার ‘ময়না বু’ চরিত্রটি এদেশীয় গ্রাম-বাংলার চিরকালীন চিত্রপট হয়ে আছে। এ ছাড়াও যেসব সিনেমায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন- ‘অংশীদার’, সুজন সখি, দাঙ্গা, বিরহ ব্যথা, ‘ভাত দে’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘প্রেম পিয়াসী’, নতুন পৃথিবী, চাষির মেয়ে, কসাই, বাঁশরী, ‘মরণের পরে’, ‘রাধা কৃষ্ণ’, ‘বাংলার বধূ’, ‘চাঁদের আলো’ ও ‘অন্তরে অন্তরে’।

কয়টি সিনেমায় তো নায়িকা হিসেবেও অভিনয় করেছিলেন, এরপর তাতে ধারাবাহিক থাকলেন না কেন- একবার এমন প্রশ্নে আনোয়ারা বলেন, ‘শাবানাও আমাকে বলত, তুই কেন নায়িকা হলি না রে? আমি হইনি। এখনো আয়নার সামনে দাঁড়ালেও মনে হয় আমি একজন চরিত্রাভিনেত্রীই। প্রতিটি গল্পে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে কাজ করতে পারি। এটা তো নায়িকারা পারে না। তারা শুধু রোমান্স করতে পারে। ঘুরে ফিরে সেই একই সংলাপ আওড়াতে জানে। নতুন কিছু করতে জানে না।’

সে জন্যই নায়িকারা একটা বয়সে চলচ্চিত্র থেকে ছিটকে পড়েন। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চরিত্রাভিনেত্রীকে বেছে নিয়েছিলেন বলেই আনোয়ারার ক্যারিয়ার এত দীর্ঘ। পঞ্চাশ বছরের ক্যারিয়ার কম নয়। একসময়ে ব্যস্ততামুখর আনোয়ারা কিছুদিন স্মৃতিবিভ্রমে ভুগেছেন।

২০২২ সালে ব্রেইন স্ট্রোক করেন। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তার স্বামী মহিতুল ইসলাম মারা যান। তিনিও দীর্ঘদিন ব্রেইনের সমস্যায় ভোগেন। আনোয়ারার মতো অবিকল্প অভিনেত্রী হালে না থাকার বাস্তবতা ইন্ডাস্ট্রি নিশ্চয় প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com