শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৪ পূর্বাহ্ন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে লেখা এক চিঠিতে তারা ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছে। যদিও দেশের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে তা দেশের বাজার পরিস্থিতি ও নির্দিষ্ট মানদণ্ডগুলোর ওপর নির্ভর করেই নির্ধারিত হয়েছে।
সংস্থাগুলো বলছে, প্রস্তাবিত মজুরি শ্রমিকদের জীবনমানের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। এটি শোভনীয় নয়। শোভন শ্রমমানের সঙ্গে এ মজুরি সাংঘর্ষিক বলেও মনে করে এ পাঁচ শ্রম অধিকার সংস্থা। পাঁচটি সংস্থা হলো ফেয়ার লেবার অ্যাসোসিয়েশন (এফএলএ), আমফোরি, এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ, ফেয়ার উইয়ার এবং মনডিয়াল এফএনভি।
এফএলএ’র এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ সংস্থাগুলো আড়াই হাজার বৈশ্বিক ব্র্যান্ড, খুচরা বিক্রেতা ও সরবরাহকারীকে প্রতিনিধিত্ব করে যারা বাংলাদেশের ২ হাজার ৯০০ কারখানা থেকে পোশাক কেনে।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক শ্রম ও শিল্পমানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং মানবাধিকারকে মান্য করে এমন একটি আইনসম্মত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার জন্য স্বাক্ষরকারী পাঁচটি প্রতিষ্ঠান শিল্পমালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিকে উৎসাহিত করছে।
শ্রম অধিকার সংস্থাগুলোর মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিষয়টি এখনও উদ্বেগের না। ন্যূনতম শ্রম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে দেশের বাজার পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেই।
তিনি বলেন, কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করেই ন্যুনতম মজুরি বাড়ানো হয়েছে। একটি হলো শিক্ষা, আরেকটি দক্ষতা। যাদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে, তাদের না আছে শিক্ষা, না আছে দক্ষতা।
এদিকে গতকাল রবিবার ব্র্যান্ড, রিটেইলার ও ক্রেতাদের কাছে শ্রম মজুরি ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে পোশাকের দাম বাড়াতে আবারও চিঠি পাঠিয়েছেন তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। চিঠিতে তিনি ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে লেখেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের উৎপাদন খরচ অত্যধিকভাবে বেড়েছে। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ, গ্যাসের দাম ২৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ডিজেলের ৬৮ শতাংশ এবং পরিবহন এবং অন্যান্য খরচেও একই রকম প্রভাব পড়েছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে মূল্যস্ফীতি রোধে সুদ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তিনি বলেন, সুদহার বাড়ানোর কারণে আমাদের বিনিয়োগ খরচ আরও বেড়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ এবং অন্যান্য খরচও বেড়েছে। শুধুমাত্র পণ্যের খরচই নয় পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ফি, ব্যাংক চার্জসহ বিভিন্ন রেজিস্ট্রেশন এবং সার্টিফিকেশন ফি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলো নিয়েই ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন ন্যূনতম মজুরি খরচ আরও বাড়বে।
তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য গঠিত বোর্ড সম্প্রতি শ্রমিকদের জন্য মালিকদের প্রস্তাব মেনে ১২ হাজার ৫০০ টাকার নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করেছে। তবে এই মজুরি নির্ধারণের আগে মালিকপক্ষ শুরুতে ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা দিতে প্রস্তাব করার পর থেকেই শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামেন। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ২৩ হাজার টাকার মজুরি দাবি করে। তবে বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করেন।
মালিকপক্ষের প্রাথমিক প্রস্তাব শ্রমিকেরা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন জোরদার করার পর শিল্পমালিকেরা নতুন করে প্রস্তাব দেয় মজুরি বোর্ডে। শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাবই বোর্ডে গৃহীত হয়। সাড়ে ১২ হাজার টাকার মজুরি প্রস্তাব দেওয়ার পেছনে কী যুক্তি কাজ করেছে, তা জানতে চাইলে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি তখন জানিয়েছিলেন যে ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়’ তারা ওই প্রস্তাব দিয়েছেন।
তবে বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন প্রস্তাবিত মজুরি কাঠামো প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যায়। এই আন্দোলনের সময় সহিসংতায় চারজন শ্রমিক নিহত হন, আহত হন আরও অনেকে। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।
পাঁচটি আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠান তাদের চিঠিতে বলেছে, ১২ হাজার ৫০০ টাকার প্রস্তাবিত মজুরি শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা ও জীবনধারণের জন্য একটি পরিমিত মান পূরণ করতে পারবে না এবং এটি সরকারের অঙ্গীকার করা একটি শোভন শ্রমমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একটি আইনসম্মত ন্যূনতম মজুরি ও জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় গড় মজুরির পার্থক্য পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি।
চিঠিতে বলা হয়েছে, মজুরির এই পার্থক্য দেশটির তৈরি পোশাকশিল্পকে আন্তর্জাতিক মান অর্জন ও ‘একটি দায়িত্বপূর্ণ উৎস দেশ’ হিসেবে বাংলাদেশের সক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারী পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময় অন্তর ন্যূনতম মজুরি সমন্বয় করার প্রতি তাদের সমর্থন জানায়। তারা একই সঙ্গে শ্রমিকদের সংগঠন, ধর্মঘট ও প্রতিবাদ করার অধিকারকে সম্মান করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায়। যেসব শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মুক্তি দিয়ে সব অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্যও আহ্বান জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর পক্ষে সমর্থন জানিয়ে চিঠিতে স্বাক্ষরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, সদস্য কোম্পানিগুলোকে ‘দায়িত্বপূর্ণ’কেনাকাটায় তারা উৎসাহিত করছে, যাতে পোশাক সরবরাহকারীরা তাদের শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে পারে। মজুরি বৃদ্ধির ফলে যে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে, তা যাতে ন্যায্য ও টেকসইভাবে ভাগাভাগি করা হয়, সে ব্যাপারেও সুপারিশ করে এসব প্রতিষ্ঠান।