সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন

কোনো সময়কেই আলাদা করে দেখি না : পাপিয়া সারোয়ার

অসামান্য গায়কী দিয়ে মানুষের মন জয় করে কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া এক সঙ্গীতশিল্পী। ১৯৬৭ সাল থেকে বেতার ও টিভিতে গান করে আসা এই কণ্ঠশিল্পী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। ছোটবেলায় ছায়ানটে ভর্তি হন। পরে বুলবুল ললিতকলায়। শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নের জন্য ভারত সরকারের বৃত্তি লাভ করেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি আধুনিক গানেও দাপট ছিল তার। পাপিয়া সারোয়ার ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ লাভ করেন। ২০২১ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। আজ তার জন্মদিন।

কী আয়োজন থাকছে এবারের জন্মদিনে? আমার জন্মদিন আমি নিজ থেকে আড়ম্বরের সঙ্গে করি না। আমার যারা ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থী আছে তারাই কেক কেটে, গান গেয়ে নানাভাবে পালন করে দিনটি। তবে শুভেচ্ছা পেলে তো মনটা খুশি হয়ই। যখন আমার পরিবার, শিক্ষার্থী, শুভানুধ্যায়ী, আত্মীয়-স্বজনদের কেউ শুভেচ্ছা জানায় তখন খুব ভালো লাগে। আলাদাভাবে কিছু করা হবে না। আমি এসব করিও না। এটা আমার একদমই পছন্দ না, কেমন যেন আদিখ্যেতা লাগে, ন্যাকামি মনে হয়। যারা এসব করেন সেটাও আমার ভালো লাগে না। আমি এরকম আদিখ্যেতা থেকে নিজেকে সবসময়ই দূরে সরিয়ে রাখতে পছন্দ করি।

ফেলে আসা জীবনের কোন সময়টা বেশি স্মরণীয়? আমার কাছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই স্মরণীয়, আনন্দের। সে জন্য জীবনের কোনো সময়কেই আলাদাভাবে দেখি না আমি। রবীন্দ্রনাথের কাব্য, গান, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ সবকিছু থেকেই আমি এই শিক্ষা পেয়েছি, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই আনন্দের।

সঙ্গীতে আসার পেছনে কার অবদান বেশি?

ছোটবেলা থেকেই আমি রবীন্দ্র অনুরাগী। নিজের পছন্দ থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতে আসা হয় আমার। ক্লাস সিক্সে থাকতে ছায়ানটে ভর্তি হই। নবম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে থাকি। তারপরে ধানমন্ডিতে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি হই। এখনো একই একাডেমিতে শিক্ষক হিসেবে আছি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই আমাদের সবসময় পথ চলা, পথ চলা মানে জীবন চলা, তাকেই আমাদের জীবনে ধারণ করে রাখা। বড় আপার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটাও তেমন ছিল। আমার গানের পেছনে তিনি সবসময়েই লেগে থাকতেন। মা-বাবা তো ছিলেনই।

শিল্প-সংস্কৃতির পরিবারের সন্তানরা এই জগতে আসছেন না, কারণ কি?

আমার দু’টি মেয়ে। সাংস্কৃতিক পরিবারের সদস্য হিসেবে তারাও সংগীত চর্চা করেন। তবে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে তারা এখন নিজ নিজ প্রফেশন নিয়েই আছেন। তারাও নিজ প্রফেশনের বাইরে সংগীত চর্চাও করেন। সাংস্কৃতিক চর্চাকে কীভাবে করবে সেটা যার যার ইচ্ছা। এ নিয়ে তো আলাদাভাবে কাউকে প্রভাবিত করাও যাবে না। তবে আমি মনে করি, ভালো সংগীতশিল্পী হওয়ার জন্য পারিবারিক ঐতিহ্য ও পরিবেশটাও দরকার। কেউ যখন ভালো একটা পারিবারিক পরিবেশ থেকে আসবে, গানে ভালো করায় তার বাড়তি একটা সুবিধা তো থাকবেই পাশাপাশি তার সবকিছুই ভালো হবে।

বর্তমান সময়ে রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রাসঙ্গিক? পরিবর্তন তো সব সময়েই ছিল। কিন্তু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এত বছর পার হয়ে গেল তারপরেও কেন আমরা এখনো রবীন্দ্রচর্চা করি। তার মানে এটা এখনো প্রাসঙ্গিক। আমার তো মনে হয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যা দেখি, যা করি, যা শুনি, সব কিছুতেই তার প্রাসঙ্গিকতা আছে। রবীন্দ্রনাথ শুধু সময়োপযোগীই না, সর্বজনীনও। তার বাণী, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছবি, যা’ই বলেন, সবকিছুই এত আধুনিক, যে সময়েই তা পাঠ করা হোক সব সময়ের সঙ্গেই এটা যায়। যা-ই পাঠ করি, মনে হবে এটা যেন আমারই মনের কথা, তখন কিন্তু আলাদাভাবে অন্যকিছু ভাবতে হয় না। কাজেই রবীন্দ্রনাথের সব সৃষ্টিকর্ম সব সময়ের জন্যই প্রাসঙ্গিক। আমাদের চারপাশের সব বিষয়ের সঙ্গে মিল থাকাতেই এখনো তিনি সার্বজনীন। তবে রবীন্দ্রচর্চায় বাড়ির পরিবেশও সেরকম হতে হবে। যিনি এই পরিবেশের নয়, সে তো রবীন্দ্রনাথের কিছু বুঝবে না।

বাংলাদেশে রবীন্দ্রগল্পে চলচ্চিত্র বলতে গেলে নেই-ই, কারণ কি? এটা ডিপেন্ড করে বাজেট, নির্মাতার রুচি ও মানসিকতার ওপর। তবে চলচ্চিত্র কম হলেও বিটিভি, বেসরকারি চ্যানেলে রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে নাটক হয়। আর চলচ্চিত্র নিয়ে আমার তেমন জানাশোনাও নেই। চলচ্চিত্রও অত দেখি না। হলের দর্শক কেমন সিনেমা পছন্দ করে সে সম্পর্কেও আমার আইডিয়া নেই। এসব না জেনে আন্দাজে বলতে পারব না কেন এখানে রবীন্দ্রনাথের গল্পে সিনেমা হচ্ছে কম। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে। সত্যজিৎ রায় করেছেন। আরও অনেকে করছেন।

‘নাই টেলিফোন, নাই রে পিয়ন, নাই রে টেলিগ্রাম’ গানটি তো অবিস্মরণীয়!

আমি জানি না, কেন এটা হলো। তখন শান্তি নিকেতন থেকে ফিরে আসি। এ সময়ে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পাঁচ-ছয় মাস পরে গানটি গাই। টেলিভিশনে মালঞ্চ নামের দশটি গানের এক অনুষ্ঠানের জন্য এই গানটি রেকর্ডিং করা হয় তখন। সুর-সংগীতায়োজন করেছিলেন মনসুর আলী সাহেব। ধীর আলী মিয়া উনার বড় ভাই। গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির। এ সময়ে ছিলেন মুসা আহমেদ। তিনি আবার একটি নাটকেও গানটি গেয়ে ফেললেন। এটা কেন সবার কাছেই ভালো লাগল জানি না। তাই মাঝে মাঝে ভাবি, সারাজীবন গাইলাম রবীন্দ্রসঙ্গীত আর কিনা এই গানটিই নিয়েই এত মাতামাতি!

এমন কী মনে হয়, চাইলে আধুনিক গানে আরও জনপ্রিয় হতেন? না, এটা আমার কখনোই মনে হয়নি। আমার যে গলা সে গলা দিয়েই আমি স্পষ্ট করে গাই। আলাদা করে গলা করি না। খোলা গলায় ও খোলা সুরে মন দিয়ে গাই। যাতে বেসুরো না হয়। আলাদা গলা করে রেওয়াজ করি না। রাগসংগীতেও তাই করি। রবীন্দ্রনাথের গান হলো মন দিয়ে, মন থেকে গাওয়া; খোলা গলায়, খোলা সুরে মন দিয়ে আত্মস্থ হয়ে যাওয়া। আমাদের তো রবীন্দ্রনাথকেই ধারণ করে পথ চলা। এই পথ চলা মানে জীবন চলা।

সিডি, অ্যালবামের যুগেও আপনার অ্যালবাম কম কেন? আমার অত কিছু ভালো লাগত না। হয় না যে, একেক জনের একেক পছন্দ থাকে। অনেক কোম্পানি থেকেই অফার নিয়ে আসত। তাদের পছন্দমতো গান নিয়ে আসত। কমন কিছু লিখে নিয়ে আসত। কিন্তু ওই কমন গানগুলো আমার পছন্দ হতো না। আমি চাইতাম নিজের পছন্দের গান গাইতে। যখন কোনোটা পছন্দ হয়েছে তখন করেছি। সব পছন্দ না হওয়াতে আমার অ্যালবাম কম হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2017 Nagarkantha.com